ওহুদের যুদ্ধ : জয়-পরাজয় না ‘অর্জন’
ওহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় বদর যুদ্ধের এক বছর পর অর্থাৎ তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে। ওহুদ একটি পর্বতের নাম। এই পর্বতের সম্মুখস্থ ময়দানে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় বলে এর নাম ওহুদ যুদ্ধ। নবুওয়াতির পূর্বে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মক্কাবাসীদের অতি আদরণীয় ও প্রিয় মিত্র। কিন্তু নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তিনি যে মুহূর্তে আল্লাহর উপর বিশ্বাস আনার জন্য মক্কাবাসীদের প্রতি আহ্বান জানান, তখন থেকেই তিনি তাদের ঘোরতর শত্রুরূপে বিবেচ্য হলেন এবং তার উপর চলল অমানুষিক নির্যাতন আর নিষ্পেষণের ষ্টিম রোলার। যার ফলশ্রুতিতে পরম করুণাময় আল্লাহ তা’আলার ইঙ্গিতে তাকে মদীনায় হিজরত করতে হয়। হিজরতের পর ধৈর্য্য-সহ্যের প্রতিকৃতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়। পড়ে পড়ে মার খাওয়া নয়- “ঔষধে কাজ না হলে অস্ত্রোপাচার” অভ্যুদয় ঘটে ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদের। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রা. এর মতে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ ১৯টি জিহাদে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন (মতান্তরে ২১, ২৪, ২৭ টি জিহাদে)।
তৃতীয় হিজরীতে ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। একে আলাদা যুদ্ধ না বলে ‘বদর যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়’ বা ধারাবাহিকতা বলেও আখ্যায়িত করা যায়। কেননা বদর যুদ্ধে মক্কাবাসী কুরাইশরা যে আঘাত পায় তার প্রতিশোধ গ্রহণের অগ্নিময় মনোবৃত্তিই ওহুদ যুদ্ধের মূল কারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সংঘটিত বড় যুদ্ধসমূহের মধ্যে ওহুদ যুদ্ধ অন্যতম প্রধান। এই যুদ্ধে মুসলমানগণ যে পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আল্লাহর তরফ থেকে পরীক্ষিত হয়েছিলেন, সমকালীন আর কোন যুদ্ধে তা হয়নি। এ কারণেই ইসলামের ইতিহাসে এই যুদ্ধ একটি শিক্ষণীয় মডেল হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।
এই যুদ্ধে কুরাইশদের ছিল প্রচুর রণসম্ভারে সমৃদ্ধ তিন হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী। বাহিনীর সামনে ছিল হোবল ঠাকুরের বিরাট এক মূর্তি আর এর পিছনে উষ্টপৃষ্টে আরোহিত রণরঙ্গিনী হিংস্র রমণীগণ রণসংগীত গেয়ে চলছিল কুরাইশ সৈন্যদের উত্তেজিত করতে। পক্ষান্তরে মুসলমানরা যখন যুদ্ধের জন্যে যাত্রা করেছিল, তখন তাদের সংখ্যা ছিল এক হাজারের মতো। এরপরও কিছুদূর গিয়ে তিন শ’ মুনাফিক আলাদা হয়ে গেল। এবার বাকী থাকলো শুধু সাত শ’ মুসলমান। তদুপরি যুদ্ধের সামানপত্র ছিল কম এবং এক তৃতীয়াংশ সৈন্যও গেল বিচ্ছিন্ন হয়ে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে কিছু লোকের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। এ সময় শুধু আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তার সাহায্যের ওপর ভরসাই মুসলমানদেরকে দুশমনদের মুকাবেলায় এগিয়ে নিয়ে চললো। এ উপলক্ষে হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে যে শান্তনা প্রদান করেন, আল্লাহ তা নিম্নোক্ত ভাষায় উল্লেখ করেছেন-
‘স্মরণ করো, যখন তোমাদের দুটি দল সাহস হারাবার উপক্রম হলো, অথচ আল্লাহ তাদের সাহায্যকারী ছিলেন, আর আল্লাহর উপরই ভরসা করা মুমিনদের উচিত। বস্তুতঃ আল্লাহ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। কাজেই আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো। আপনি যখন বলতে লাগলেন মুমিনগণকে- তোমাদের জন্য কি যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের সাহায্যার্থে তোমাদের পালনকর্তা আসমান থেকে অবতীর্ণ তিন হাজার ফেরেশতা পাঠাবেন। অবশ্য তোমরা যদি সবর কর এবং বিরত থাক আর তারা যদি তখনই তোমাদের উপর চড়াও হয়, তাহলে তোমাদের পালনকর্তা চিহ্নিত ঘোড়ার উপর পাঁচ হাজার ফেরেশতা তোমাদের সাহায্যে পাঠাতে পারেন। বস্তুতঃ এটা তো আল্লাহ তোমাদের সুসংবাদ দান করলেন, যাতে তোমাদের মনে এতে শান্তনা আসতে পারে। আর সাহায্য শুধুমাত্র পরাক্রান্ত, মহাজ্ঞানী আল্লাহরই পক্ষ থেকে।’ [সূরা আলে ইমরান : ১২২-১২৬]
৬২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি, তৃতীয় হিজরীর ১১ শাওয়াল (মতান্তরে ১৫ শাওয়াল) শনিবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহুদের ময়দানে পৌঁছেন। স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিরাট শত্রুবাহিনীর মুখোমুখী হতে হবে বিধায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি সূক্ষ কৌশল অবলম্বন করলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা. এর নেতৃত্বে পঞ্চাশ জনের একটি তীরান্দাজ বাহিনী সংকীর্ণ গিরিসংকুল পথে মোতায়েন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর হুঁশিয়ারী দিলেন, যাতে তারা যেন কোন অবস্থাতেই উক্ত স্থান পরিত্যাগ না করে, যদিও বা বাকী সৈন্যরা এমনকি তিনি স্বয়ং শহীদও হন। কেননা তাদের সামান্য অনুপস্থিতির সুযোগে পিছন দিক থেকে শত্রু সৈন্যদের আক্রমণের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা ছিল।
আক্রমণ শুরু হল। কাফেরদের পক্ষ থেকে তালহা প্রচণ্ড দম্ভভরে মুসলমানদের কটাক্ষ করতে করতে ময়দানে নামা মাত্রই শেরে খোদা হযরত আলী রা. তরবারির এক আঘাতে তাকে দ্বিখণ্ডিত করে তার দম্ভের জবাব দিলেন। অতঃপর তালহার পুত্র ওসমান অগ্রসর হলে মহাবীর হামজা রা. তদ্রুপ জবাব দিলেন।
এরপর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মুসলিম বাহিনী আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে শত্রু নিধন করতে করতে অগ্রসর হতে থাকে, আর শত্রুপক্ষ বিপর্যস্ত হয়ে পিছনে হটতে থাকে; এমনকি উত্তেজনা সৃষ্টিকারী নারী বাহিনী তাদের রণসংগীত ভঙ্গ করে পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকে। রণাঙ্গণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুপ্রেরণায় যে মুহূর্তে মুসলমানদের বিজয় সুনিশ্চিত হয়ে ওঠেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে আকস্মাৎ যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল, জয়-পরাজয়ে পরিবর্তন ঘটে গেল।
দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলমানরা এ বিজয় ধরে রাখতে পারলেন না। আল্লাহর উপর সুগভীর বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে দৃঢ় চিত্ততায় একতাবদ্ধ হয়ে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করে বিজয় যখন হাতের মুঠোয় এবং কুরাইশরা প্রচণ্ড মার খেয়ে যখন পশ্চাদ্ধাবনরত; ঠিক সেই সময়ে মুসলমানদের এক অংশ বিজয় হয়েছে ভেবে গনিমতের মাল সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে পেছন দিক থেকে শত্রুর আক্রমণকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য যে তীরান্দাজ বাহিনীকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর হুঁশিয়ারী দিয়েছিলেন, যেন তারা কোন অবস্থাতেই এই নির্ধারিত স্থান ত্যাগ না করে, তারাও অন্যদের অনুসরণ করে গিরি-উপত্যকা ত্যাগ করে শত্রুপক্ষের ফেলে যাওয়া মাল সংগ্রহে লিপ্ত হয়ে যায়। খালিদ বিন অলীদ তখন কাফির সৈন্যদের একজন অধিনায়ক। সে এই সুবর্ণ সুযোগ কে পুরোপুরি কাজে লাগানো এবং পাহাড়ের পেছন দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে সুড়ঙ্গ-পথে মুসলমানদের ওপর হামলা করলো। হযরত আবদুল্লাহ এবং তার ক’জন সঙ্গী শেষ পর্যন্ত সুড়ঙ্গ পথের প্রহরায় ছিলেন, তাদের অধিকাংশই এই হামলার মুকাবেলা করলেন। কিন্তু কাফের দের এই প্রচণ্ড হামলাকে তারা প্রতিহত করতে পারলেন না। তারা শহীদ হয়ে গেলেন। অতঃপর দুশমনরা একে একে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওদিকে যে সব পলায়নপর কাফির দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিল, তারাও আবার ফিরে এলো। এবার দুদিক দিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলা শুরু হলো। এই অভাবিত পরিস্থিতিতে মুসলমানদের মধ্যে এমন আতঙ্কের সঞ্চার হলো যে, যুদ্ধের মোড়ই সম্পূর্ণ ঘুরে গেলো। মুসলমানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক পালাতে লাগলেন।
এতদসত্তেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দলীয় সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ না করে আক্রমণ প্রতিহত করার আহ্বান জানান। কিন্তু শত্রুপক্ষের প্রচণ্ড আক্রমণের কারণে তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। তথাপি তারা থেমে থাকেননি। পর্যায়ক্রমে এক একজন বীর সেনানী অগ্রসর হয়ে শত্রুপক্ষের সৈন্যকে পিছনে হটাতে থাকে। এ সময় রণাঙ্গনে গুজব রটে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহীদ হয়েছেন। এই একটি খবরে যুদ্ধরত দু’শিবিরে দু’ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শহীদ হওয়ার খবরে মুসলিম বাহিনী বে-পরোয়াভাবে শত্রুর মোকাবেলায় তৎপর হয়ে ওঠে। তারা ভাবলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি বেঁচে না থাকেন তাহলে আমাদের বেঁচে থাকার যুক্তি নেই। তার চাইতে শাহাদত বরণই শ্রেয়। অন্যদিকে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাহাদতকে বিজয় মনে করে যুদ্ধ চালনা অনাবশ্যক মনে করল। তদুপরি সংখ্যায় নগণ্য হলেও মুসলমানদের প্রতিরোধের মুখে কুরাইশ বাহিনী মদীনার দিকে অগ্রসর না হয়ে পিছনে ফিরে মক্কার দিকে চলল এবং তাদের নেতা আবু সুফিয়ান হুমকি দেয় “আমি প্রতিশোধ নিয়েছি, আগামী বছর নতুন করে বদর প্রান্তরে তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে।”
ওহুদ যুদ্ধে কারা জয়ী হয়েছে- তা সত্যিই বিতর্কিত। কেননা বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় মুসলমানদেরই পরাজয় হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের পরাজয় ঘটেনি বরং হয়েছে অর্জন। সে সম্পর্কিত কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো-
০১. নেতার আদেশ মান্য করলে তা হয় কল্যাণকর আর লংঘন করলে অকল্যাণ বয়ে আনে, তা মুসলমানগণ যুগপৎভাবে অনুধাবন করেছিলেন। যার ফলে ভবিষ্যতে আর এর পুনারাবৃত্তি ঘটেনি।
০২. পার্থিব লোভ-লালসার কারণে নিজ সম্পদও যে হাতছাড়া হয়ে যায় ওহুদের যুদ্ধ এই শিক্ষাই দেয়।
০৩. এই যুদ্ধে মুসলমানগণ বহু আকাংখিত শাহাদতের মৃত্যু লাভের সুযোগ পান।
০৪. কারা প্রকৃত মুসলিম আর কারা মুনাফিক তা ওহুদ রণাঙ্গন থেকেই স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়।
০৫. বিজয় অর্জনের চাইতে তা ধরে রাখা যে অধিকতর কঠিন ও সুফল দায়ক এবং এ লক্ষ্যে যুদ্ধ জয়ের পূর্বদিন অপেক্ষা পরের দিন বেশি সতর্কতাবস্থায় থাকতে হয়, এ যুদ্ধ থেকে মুসলমানগণ এই শিক্ষা অর্জন করেন।
০৬. নিরবছিন্ন বিজয় কোন জাতির ভাগ্যেই আসে না। জয়-পরাজয়, সুখ-দুঃখ, জাগতিক জীবনে অবশ্যম্ভাবী এবং ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে যে এসবের মোকাবেলা করতে হয় এ শিক্ষাও তারা এখান থেকে পান।
০৭. ‘দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় না মহীতে’। অনায়াসলব্ধ বস্তুর কদর অপেক্ষাকৃত কম। এরূপ প্রাপ্তি অলসতার জন্ম দেয়। কাজেই ওহুদ যুদ্ধের দুর্লভ প্রাপ্তি পরবর্তী বিজয়সমূহের পথ সুগম করে দেয়।
০৮. আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছা- ‘কাফিররা ধ্বংস হোক মুসলমানদের মোকাবেলায়’। কাজেই প্রতি যুদ্ধেই যদি কাফেররা পরাজিত হয় তাহলে তো তারা সম্মুখ সমরে না এসে দূর থেকে অথবা লুক্কায়িত থেকে ইসলামের অনিষ্ট সাধন করতে থাকবে। এ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে ওহুদের পরাজয় বিফলে যায়নি।
০৯. সাহাবীগণের ন্যায় অতুলনীয় ভক্তবৃন্দকে প্রতিনিয়ত বিশেষ বিশেষ সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে পরবর্তী জীবনে এবং সে সব সংকটকালে তাঁদের কি করণীয় তার শিক্ষা নেয়ার সুযোগ হয়েছিল ওহুদ রণাঙ্গণের অংশ বিশেষ থেকে।
১০. ব্যর্থতায় বিমর্ষতা আর সাফল্যে অতি হর্ষোৎফুল্লতা যে অকল্যাণ বয়ে আনে এর প্রমাণ ওহুদ যুদ্ধ।
১১. ওহুদ যুদ্ধে সত্তর জন মুসলিম শহীদ হন, কিন্তু কেউ-ই বন্দী হননি। পক্ষান্তরে বদর যুদ্ধে কাফেরদের সত্তর জন নিহত ও সত্তর জন বন্দী হয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে প্রশ্ন- কুরাইশরা কি আদৌ জয় লাভ করেছিল?
১২. বিজয়ের মূল্যায়ন সম্মুখ পানে অগ্রসর হওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে কুরাইশরা পেছন দিকে অর্থাৎ মক্কার দিকে রওয়ানা দেয়। পক্ষান্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ওহুদের ময়দানে তিনদিন অবস্থান করে শহীদদের দাফন-কাফনসহ বহু প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করেন।
১৩. কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের হুমকি- “আমি প্রতিশোধ নিয়েছি, আগামী বছর নতুন করে বদর প্রান্তরে তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে।” এটা কোন ক্রমেই বিজেতার উক্তি হতে পারে না।
১৪. মুসলিমরা যদি পরাজিতই হবে, তাহলে কুরাইশরা মদীনা দখল না করেই ফিরে যাবে কেন?
পরিশেষে, যদিও ঐতিহাসিকগণ ওহুদের জয়-পরাজয়ের বিষয়টি বিতর্কিত বলে আখ্যায়িত করেছেন, তথাপি উপরের আলোচনার আলোকে এটাকে মুসলিমদের পরাজয় বা কুরাইশদের নিরঙ্কুশ বিজয় বলে ধরে নেয়া যায় না। একথা ঠিক যে, এই যুদ্ধে মুসলমানগণ যথেষ্ট ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আল্লাহর তরফ থেকে পরীক্ষিত হয়েছিলেন। সোনা যেমন আগুনে পুড়ে খাঁটি হয়, তেমনি মুসলমানগণ এই যুদ্ধ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে খাঁটি সোনায় রূপান্তরিত হন। কাজেই ওহুদ যুদ্ধের প্রাপ্তি ন্যূনতম হলেও অন্তর্নিহিত প্রাপ্তির গুরুত্ব অপরিসীম।
এ প্রেক্ষাপটে নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়- এটা মুসলমানদের জয়-পরাজয় নয় বরং ‘অর্জন’। আর এই অর্জনের ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।
-----------------------------------------
বইঃ মুখতাসার যাদুল মা‘আদ , অধ্যায়ঃ অনুচ্ছেদ সমুহের সূচী ও বিবরন, অনুচ্ছেদঃ উহুদ যুদ্ধের শিক্ষা - প্রথম ভাগ
উহুদ যুদ্ধের শিক্ষা - প্রথম ভাগ
উহুদ যুদ্ধে যে সমস্ত শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আল-ইমরানের ১২১ নং আয়াত থেকে শুরু করে ১৬০ নং আয়াতের মধ্যে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে মুসলমানদেরকে রসূলের কথা অমান্য করা, মতভেদ করা এবং ছত্রভঙ্গ হওয়ার মন্দ পরিণাম সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া। যাতে তারা ভবিষ্যতে সতর্ক হয়ে যায় এবং যে সমস্ত বিষয় তাদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে তা থেকে বিরত থাকে।
নাবী-রসূল ও তাদের অনুসারীদের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ একটি হিকমত ও রীতি হচ্ছে তারা কখনও জয়লাভ করবে আবার কখনও পরাজিত হবে। তবে সর্বশেষে তাদেরই বিজয় হবে। সবসময় তাদেরকে বিজয় দান করলে সত্যিকার মুমিন ও অন্যদের মাঝে পার্থক্য করা সম্ভব হবেনা। আর সবসময় পরাজিত করলে নাবী-রসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য সফল হবেনা।
ﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻟِﻴَﺬَﺭَ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﺎ ﺃَﻧْﺘُﻢْ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺣَﺘَّﻰ ﻳَﻤِﻴﺰَ ﺍﻟْﺨَﺒِﻴﺚَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻄَّﻴِّﺐِ ﻭَﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻟِﻴُﻄْﻠِﻌَﻜُﻢْ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻐَﻴْﺐِ ﻭَﻟَﻜِﻦَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻳَﺠْﺘَﺒِﻲ ﻣِﻦْ ﺭُﺳُﻠِﻪِ ﻣَﻦْ ﻳَﺸَﺎﺀُ ﻓَﺂﻣِﻨُﻮﺍ ﺑِﺎﻟﻠﻪِ ﻭَﺭُﺳُﻠِﻪِ ﻭَﺇِﻥْ ﺗُﺆْﻣِﻨُﻮﺍ ﻭَﺗَﺘَّﻘُﻮﺍ ﻓَﻠَﻜُﻢْ ﺃَﺟْﺮٌ ﻋَﻈِﻴﻢٌ
‘‘তোমরা বর্তমানে যে অবস্থায় আছো, আল্লাহ মুমিনদের কখনও সেই অবস্থায় থাকতে দিবেন না। পাক-পবিত্র লোকদেরকে তিনি নাপাক ও অপবিত্রকে লোকদের থেকে আলাদা করেই ছাড়বেন। কিন্তু তোমাদেরকে গায়েবের খবর জানিয়ে দেয়া আল্লাহর রীতি নয়। কিন্তু আল্লাহ্ তাঁর রসূলদের মধ্যে হতে যাকে ইচ্ছা বাছাই করে নেন। সুতরাং আল্লাহর উপর এবং তাঁর রসূলগণের উপর তোমরা ঈমান আনয়ন কর। তোমরা যদি বিশ্বাসী হও এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তোমাদের জন্যে রয়েছে বিরাট প্রতিদান।’’[1] অর্থাৎ মুমিন ও মুনাফিকরা যেভাবে একসাথে মিশ্রিত অবস্থায় আছে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে সে অবস্থায় রেখে দিবেন না। বরং তিনি প্রকৃত মুমিনদেরকে মুনাফেকদের থেকে আলাদা করবেন। যেমন তিনি করেছিলেন উহুদ যুদ্ধের দিন। আল্লাহ্ তা‘আলা কাউকে গায়েবের খবর অবগত করেন না। কেননা গায়েবের মাধ্যমেই তিনি বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য করেন। আল্লাহ্ তা‘আলা চেয়েছেন যে, বাহ্যিকভাবেও যেন বিশ্বাসী ও মুনাফেকদের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। আর উহুদ যুদ্ধে তাই হয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তিনি তাঁর রসূলদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তাকে গায়েবের খবর অবগত করেন।
সুতরাং হে মুমিনগণ! তোমরা সেই গায়েবের প্রতি ঈমান আনয়নের মাধ্যমেই সৌভাগ্যবান হবে, যা তিনি তাঁর রসূলগণকে অবগত করেন। তোমরা যদি গায়েবের প্রতি ঈমান আনয়ন কর এবং তাকওয়ার পথ অবলম্বন কর, তাহলে তোমাদের জন্য রয়েছে বিরাট পুরস্কার।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের মধ্যে আরেকটি হিকমত এই ছিল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা দেখাতে চান যে, তাঁর খাঁটি বন্ধুরা সুখে-দুঃখে এবং পছন্দে-অপছন্দে তথা সকল অবস্থাতেই আল্লাহর ইবাদত করে। সুতরাং আল্লাহর প্রকৃত বান্দা তারাই, যারা উভয় অবস্থাতেই আল্লাহর ইবাদত করে। তারা ঐ সকল লোকদের মত নয়, যারা শুধু সুখে থাকা অবস্থাতেই আল্লাহর পথে থাকে।
আল্লাহ্ যদি সবসময় তাদেরকে বিজয়ী করতেন, তাহলে তাদের অবস্থা ঐ সব লোকদের মতই হতো, যাদেরকে রিযিকের ব্যাপারে প্রশস্ততা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় হিকমত ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সকল মাখলুকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। তিনি মাখলুকের সকল অবস্থা সম্পর্কে জানেন ও তা দেখেন।
বান্দারা যখন আল্লাহর দরবারেই নিজেদের অক্ষমতা ও অপারগতা তুলে ধরে দু’আ করে তখন তারা বিজয়ের হকদার হয়ে যায়। আর দুর্বলতা ও পরাজয়ের লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার পর বিজয়ের পোশাক খুব ভাল লাগে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﻧَﺼَﺮَﻛُﻢُ ﺍﻟﻠﻪُ ﺑِﺒَﺪْﺭٍ ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢْ ﺃَﺫِﻟَّﺔٌ ﻓَﺎﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠﻪَ ﻟَﻌَﻠَّﻜُﻢْ ﺗَﺸْﻜُﺮُﻭﻥَ
‘‘বস্ত্তত আল্লাহ্ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। কাজেই আল্লাহ্কে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার। (সূরা আল-ইমরান-০৩:১২৩)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-
ﻟَﻘَﺪْ ﻧَﺼَﺮَﻛُﻢُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻓِﻲ ﻣَﻮَﺍﻃِﻦَ ﻛَﺜِﻴﺮَﺓٍ ﻭَﻳَﻮْﻡَ ﺣُﻨَﻴْﻦٍ ﺇِﺫْ ﺃَﻋْﺠَﺒَﺘْﻜُﻢْ ﻛَﺜْﺮَﺗُﻜُﻢْ ﻓَﻠَﻢْ ﺗُﻐْﻦِ ﻋَﻨْﻜُﻢْ ﺷَﻴْﺌًﺎ ﻭَﺿَﺎﻗَﺖْ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢُ ﺍﻟْﺄَﺭْﺽُ ﺑِﻤَﺎ ﺭَﺣُﺒَﺖْ ﺛُﻢَّ ﻭَﻟَّﻴْﺘُﻢْ ﻣُﺪْﺑِﺮِﻳﻦَ ﺛُﻢَّ ﺃَﻧْﺰَﻝَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺳَﻜِﻴﻨَﺘَﻪُ ﻋَﻠَﻰ ﺭَﺳُﻮﻟِﻪِ ﻭَﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﻭَﺃَﻧْﺰَﻝَ ﺟُﻨُﻮﺩًﺍ ﻟَﻢْ ﺗَﺮَﻭْﻫَﺎ ﻭَﻋَﺬَّﺏَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻛَﻔَﺮُﻭﺍ ﻭَﺫَﻟِﻚَ ﺟَﺰَﺍﺀُ ﺍﻟْﻜَﺎﻓِﺮِﻳﻦَ
‘‘আল্লাহ্ তোমাদের সাহায্য করেছেন অনেক ক্ষেত্রে এবং হোনাইনের দিনে, যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদের প্রফুল্ল করেছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেবও তোমাদের জন্যে সংকুচিত হয়েছিল। অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। তারপর আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূল ও মুমিনদের উপর নাযিল করেন নিজের পক্ষ থেকে প্রশান্তি এবং অবতীর্ণ করেন এমন সেনাবাহিনী, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি। আর শাস্তি প্রদান করেন কাফেরদের এবং এই হল কাফেরদের কর্মফল’’।[2]
আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় বানদাদের জন্য বেহেশতের মধ্যে এমন কিছু মর্যাদা নির্ধারণ করেছেন, যা শুধু আমলের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। বালা-মসিবতে আক্রান্ত হওয়া ব্যতীত তা পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব নয়। সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের জন্য বালা-মসিবত দ্বারা পরীক্ষা করার পর উক্ত মনজিলে পৌঁছায়ে দেন। সেই সাথে তিনি সৎ আমল করারও তাওফীক দান করেন।
সর্বদা সুস্থ থাকা, সবসময় বিজয় অর্জন হতে থাকা এবং প্রচুর নিয়ামাত ও কল্যাণের মধ্যে থাকা মুমিনদেরকে দুনিয়ার মায়া-মমতায় ফেলে দেয় এবং তাদের হৃদয়ের মধ্যে মরিচা পড়ে যায় এবং আল্লাহর পথে এবং আখিরাতের সুন্দর জীবনের দিকে চলতে হৃদয়কে বাধাগ্রস্ত করে।
আর আল্লাহ্ যখন তাঁর কোন বান্দাকে সম্মানিত করতে চান তখন তাকে বালা-মসিবতে ফেলে আখিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনেন। এটিই হচ্ছে তার চিকিৎসা।
উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে আল্লাহর নিকট শাহাদাত হচ্ছে সর্বোচ্চ মর্যাদা। তাই তিনি স্বীয় বন্ধুদের মধ্য হতে কতিপয়কে শহীদ হিসাবে বেছে নিতে চান।
আল্লাহ্ তা‘আলা যখন তার দুশমনদেরকে হালাক (ধ্বংস) করতে চান তখন তাদেরকে দিয়ে এমন কিছু করিয়ে নেন, যাতে তারা ধ্বংসের হকদার হয়ে যায়। এ সবের মধ্যে রয়েছে, কুফরীতে বাড়াবাড়ি করা, সীমা লংঘন করা, আল্লাহর অলীদেরকে মাত্রাতিরিক্ত কষ্ট দেয়া, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইত্যাদি। এর মাধ্যমে আল্লাহর বান্দাগণ গুনাহ থেকে পবিত্র হয়ে যায় এবং দুশমনরা ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻟَﺎ ﺗَﻬِﻨُﻮﺍ ﻭَﻟَﺎ ﺗَﺤْﺰَﻧُﻮﺍ ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢُ ﺍﻟْﺄَﻋْﻠَﻮْﻥَ ﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﻣُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﺇِﻥْ ﻳَﻤْﺴَﺴْﻜُﻢْ ﻗَﺮْﺡٌ ﻓَﻘَﺪْ ﻣَﺲَّ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡَ ﻗَﺮْﺡٌ ﻣِﺜْﻠُﻪُ ﻭَﺗِﻠْﻚَ ﺍﻟْﺄَﻳَّﺎﻡُ ﻧُﺪَﺍﻭِﻟُﻬَﺎ ﺑَﻴْﻦَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻭَﻟِﻴَﻌْﻠَﻢَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﻭَﻳَﺘَّﺨِﺬَ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﺷُﻬَﺪَﺍﺀَ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﻟَﺎ ﻳُﺤِﺐُّ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤِﻴﻦَ ﻭَﻟِﻴُﻤَﺤِّﺺَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﻭَﻳَﻤْﺤَﻖَ ﺍﻟْﻜَﺎﻓِﺮِﻳﻦَ
‘‘আর তোমরা নিরাশ হয়োনা এবং দুঃখ করোনা। যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে। তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ্ জানতে চান, কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ্ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না। আর এ কারণে আল্লাহ্ ঈমানদারদেরকে পাক-সাফ করতে চান এবং কাফেরদেরকে ধ্বংস করে দিতে চান।’’ (সূরা আল-ইমরান-৩:১৩৯-১৪১) এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তা‘আলা একই সাথে মুমিনদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন এবং উহুদের যুদ্ধে তাদের যে ক্ষতি হয়েছিল তার জন্য উত্তমভাবে শান্তনা দিয়েছেন। সেই সাথে যে কারণে উহুদ যুদ্ধে তাদের উপর কাফেরদেরকে বিজয়ী করেছেন তাও বলে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﺇِﻥْ ﻳَﻤْﺴَﺴْﻜُﻢْ ﻗَﺮْﺡٌ ﻓَﻘَﺪْ ﻣَﺲَّ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡَ ﻗَﺮْﺡٌ ﻣِﺜْﻠُﻪُ ﻭَﺗِﻠْﻚَ ﺍﻟْﺄَﻳَّﺎﻡُ ﻧُﺪَﺍﻭِﻟُﻬَﺎ ﺑَﻴْﻦَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ
‘‘তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি’’। (সূরা আল-ইমরান-৩:১৪০) সুতরাং তোমাদের কি হল যে, তোমরা নিরাশ হচ্ছ এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছ। ইতিপূর্বে কাফেররাও আহত হয়েছে। আর তাদের সেই আঘাত ছিল শয়তানের পথে। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি দুনিয়ার দিনসমূহ মানুষের মাঝে ঘুরিয়ে থাকেন। কেননা এটি এমন বিষয়, যা দুনিয়াতে তিনি তাঁর বন্ধু ও শত্রু উভয় শ্রেণীর লোকদের মধ্যেই ভাগ করে থাকেন। তবে আখিরাতের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে কেবল আল্লাহর বন্ধুগণই নেয়ামত ভোগ করবে। আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হিকমত উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে খাঁটি মুমিনদেরকে মুনাফেকদের থেকে আলাদা করা। ইতিপূর্বে মুনাফেকদেরকে মুমিনগণ চিনতেন না। তারা কেবল আল্লাহর ইলমেই ছিল। এবার মুমিনগণ মুনাফেকদেরকে কপালের চোখ দিয়ে দেখে নিলেন এবং গায়েবী বিষয়টি জেনে ফেললেন।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের আরেকটি হিকমতের কথা উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের থেকে কাউকে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করা।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﻟَﺎ ﻳُﺤِﺐُّ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤِﻴﻦَ
‘‘আর আল্লাহ্ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না’’। এখানে সুক্ষ্ণ ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুনাফেকরা যেহেতু উহুদ যুদ্ধের দিন আল্লাহর নাবীকে ফেলে চলে এসেছিল, তাই তিনি তাদেরকে পছন্দ করেন নি এবং তাদের থেকে কাউকে শহীদ হিসাবেও গ্রহণ করেন নি। উহুদ যুদ্ধে মুমিনদের পরাজয়ের আরেকটি হিকমত হচ্ছে, তাদেরকে গুনাহ্ থেকে পবিত্র করা এবং মুনাফেকদের থেকে আলাদা করা। উহুদ যুদ্ধের পর থেকে মুমিনগণ মুনাফেকদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।
এতে আরও হিকমত রয়েছে যে, প্রথমে কাফেরদেরকে সীমালংঘনের সুযোগ দেয়া এবং সেই কারণে তাদেরকে ধ্বংস করা। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ সমস্ত মুমিনদের ধারণা খন্ডন করেছেন, যারা মনে করত যে, বিনা জিহাদেই জান্নাতে যাওয়া যাবে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﺃَﻡْ ﺣَﺴِﺒْﺘُﻢْ ﺃَﻥْ ﺗَﺪْﺧُﻠُﻮﺍ ﺍﻟْﺠَﻨَّﺔَ ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﻳَﻌْﻠَﻢِ ﺍﻟﻠﻪُ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺟَﺎﻫَﺪُﻭﺍ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﻭَﻳَﻌْﻠَﻢَ ﺍﻟﺼَّﺎﺑِﺮِﻳﻦَ
‘‘তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ্ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্যশীল?’’ (সূরা আল-ইমরান-৩: ১৪২) অর্থাৎ তোমাদের থেকে এখন পর্যন্ত উহা লক্ষ্য করা যায়নি। যাতে করে তার পুরুস্কার দেয়া যায়। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা মুমিনদেরকে এই বলে ধমক দিয়েছেন যে, তোমরা যেহেতু জিহাদের কামনা করেছিলে এবং শত্রুদের সাথে মুকাবেলা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলে, তাই এখন পলায়ন করলে কেন? আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺗَﻤَﻨَّﻮْﻥَ ﺍﻟْﻤَﻮْﺕَ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞِ ﺃَﻥْ ﺗَﻠْﻘَﻮْﻩُ ﻓَﻘَﺪْ ﺭَﺃَﻳْﺘُﻤُﻮﻩُ ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢْ ﺗَﻨْﻈُﺮُﻭﻥَ
‘‘আর তোমরা তো মৃত্যু আসার আগেই মরণ কামনা করতে, কাজেই এখন তো তোমরা তা চোখের সামনে উপস্থিত দেখতে পাচ্ছ’’। (সূরা আল-ইমরান-৩: ১৪৩) আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন- আল্লাহ্ তা‘আলা যখন তাঁর নাবীর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বদরের যুদ্ধের শহীদদের মর্যাদা সম্পর্কে অবগত করলেন তখন ঐ সমস্ত মুসলমান নতুন কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে শাহাদাতের তামান্না (আকাঙ্খা) প্রকাশ করলেন, যারা বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের জন্য উহুদ যুদ্ধে বের হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। সেখানে গিয়ে কতিপয় লোক ব্যতীত যখন তারা পলায়ন করল তখন আল্লাহ্ তা‘আলা উপরোক্ত আয়াত নাযিল করেন।
উহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের আরেকটি কারণ ছিল এই যে, নাবী (সাঃ) জীবিত থাকতেই এমন একটি ভূমিকা পেশ করা যাতে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত থাকবে যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) অচিরেই মৃত্যু বরণ করবেন। নিয়ামতের প্রকৃত শোকর আদায়কারী তারাই হতে পারবে, যারা তাদের মাঝে রসূল (সাঃ) জীবিত থাকার নিয়ামতের কদর বুঝতে সক্ষম হবে তাঁর সাথে দৃঢ় থাকবে এবং পশ্চাৎমুখী হবেনা। যারা এ রকম হবার তাওফীক প্রাপ্ত হবে তারাই পুরস্কৃত হবে। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন যে, প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করবে। মুহাম্মাদ (সাঃ)ও মৃত্যু বরণ করবেন। কারণ তাঁর পূর্বেও অনেক নাবী-রসূল মৃত্যু বরণ করেছেন। তাদের সাথেও অনেক অনুসারী নিহত হয়েছেন। আর যারা বেঁচে ছিলেন, তারা দূর্বল হয়ে যান নি কিংবা যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিরাশ হয়ে যান নি। তারা শক্ত মনোবল ও সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি নিয়ে যুদ্ধ করে শাহাদাত অর্জনের স্পৃহা নিয়ে বেঁচে ছিলেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) অনন্তকাল বেঁচে থাকার জন্য প্রেরিত হন নি। সুতরাং তিনি মারা গেলে বা নিহত হলে মুসলমানদের পিছপা হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাদেরকে তাঁর রেখে যাওয়া দ্বীন ও তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে এবং মৃত্যু বা নিহত হওয়া পর্যন্ত এর উপরই অবিচল থাকতে হবে।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ সমস্ত বিষয়ের আলোচনা করেছেন, যার মাধ্যমে নাবী-রসূল ও তাদের অনুসারীগণ তাদের জাতির উপর জয়লাভ করেছিলেন। আর তা হচ্ছে নিজেদের ভুল-ত্রুটি স্বীকার করা, তাওবা করা, সত্যের উপর অটুট রাখার জন্য তাদের প্রভুর কাছে প্রার্থনা করা এবং শত্রুর উপর জয়লাভ করার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﻗَﻮْﻟَﻬُﻢْ ﺇِﻟَّﺎ ﺃَﻥْ ﻗَﺎﻟُﻮﺍ ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﺍﻏْﻔِﺮْ ﻟَﻨَﺎ ﺫُﻧُﻮﺑَﻨَﺎ ﻭَﺇِﺳْﺮَﺍﻓَﻨَﺎ ﻓِﻲ ﺃَﻣْﺮِﻧَﺎ ﻭَﺛَﺒِّﺖْ ﺃَﻗْﺪَﺍﻣَﻨَﺎ ﻭَﺍﻧْﺼُﺮْﻧَﺎ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡِ ﺍﻟْﻜَﺎﻓِﺮِﻳﻦَ ﻓَﺂَﺗَﺎﻫُﻢُ ﺍﻟﻠﻪُ ﺛَﻮَﺍﺏَ ﺍﻟﺪُّﻧْﻴَﺎ ﻭَﺣُﺴْﻦَ ﺛَﻮَﺍﺏِ ﺍﻟْﺂَﺧِﺮَﺓِ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﻳُﺤِﺐُّ ﺍﻟْﻤُﺤْﺴِﻨِﻴﻦَ
‘‘তারা আর কিছুই বলেনি, শুধু বলেছে, হে আমাদের প্রতিপালক! মোচন করে দাও আমাদের পাপ এবং যা কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমাদের কাজে। আর আমাদেরকে দৃঢ় রাখ এবং কাফেরদের উপর আমাদেরকে সাহায্য কর। অতঃপর আল্লাহ্ তাদেরকে দুনিয়ার সওয়াব দান করেছেন এবং যথার্থ আখিরাতের সওয়াব। আর যারা সৎকর্মশীল আল্লাহ্ তাদেরকে ভালবাসেন’’। (সূরা আল-ইমরান-৩: ১৪৭-১৪৮) সুতরাং তারা আল্লাহর কাছে তাদের গুনাহ্ থেকে ক্ষমা চেয়েছেন, যুদ্ধের সময় তাদের পদসমূহকে দৃঢ় রাখার দু’আ করেছেন এবং আল্লাহর সাহায্য চেয়েছেন। কেননা তারা জেনেছিল যে, মুসলমানদের গুনাহের কারণেই তাদের উপর দুশমনরা জয়লাভ করে থাকে এবং শয়তান তাদের গোমরাহ করে ও এর মাধ্যমেই তাদেরকে পরাজিত করে। গুনাহ্সমূহ দুই প্রকার। (১) হকসমূহ আদায়ের ক্ষেত্রে ত্রুটি করা এবং (২) কিছু গুনাহ হয়ে থাকে সীমালংঘনের কারণে। আর আনুগত্য করার মাধ্যমেই মুসলমানদের জন্য আল্লাহর সাহায্য এসে থাকে। তারা বলেছিলেন- হে আমাদের প্রতিপালক! মোচন করে দাও আমাদের পাপ এবং যা কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমাদের কাজে। আর আমাদেরকে দৃঢ় রাখ এবং কাফেরদের উপর আমাদেরকে সাহায্য কর। তারা জেনেছিল যে, আল্লাহ্ যদি তাদেরকে দৃঢ়পদ না রাখেন এবং সাহায্য না করেন, তাহলে কখনই তারা জয়লাভ করতে পারবেন না। তারা আল্লাহর কাছে ঐ বিষয় চেয়েছিলেন, যা আল্লাহর হাতে রয়েছে। তারা উভয় দিকের প্রতিই খেয়াল রেখেছিলেন। তাওহীদের বাস্তবায়ন এবং উহার হকসমূহ পরিপূর্ণরূপে আদায় করে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। সেই সাথে বিজয় আসার পথে যে সমস্ত বাধা থাকতে পারে তা দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর তা হচ্ছে পাপাচারিতা ও জুলুম। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা মুনাফেক ও মুশরিক শত্রুদের তাবেদারী করতে নিষেধ করেছেন। তারা যদি শত্রুদের আনুগত্য করে তাহলে তারা উভয় জগতেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে ঐ সমস্ত মুনাফেকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের পর কাফেরদের পূর্ণ তাবেদারী করা শুরু করে দিয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- তিনিই মুমিনদের অভিভাবক এবং সর্বোত্তম সাহায্যকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি মুহাববাত রাখবে সেই বিজয়ী হবে। তিনি শত্রুদের অন্তরে ভয় ঢেলে দিবেন। যেই ভয় তাদেরকে মুসলমানদের উপর হামলা করতে বাধা দিবে। শিরক ও কুফরীর কারণেই এমন ভীতি তাদের অন্তরে প্রবেশ করবে। যেই মুমিন ঈমানের সাথে শিরক মিশ্রিত করে নি, তার জন্যই রয়েছে হিদায়াত ও নিরাপত্তা।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি মুমিনদেরকে সাহায্য করার সত্য ওয়াদা করেছেন এবং বলেছেন যে, তারা যদি বরাবরই আনুগত্য করতে থাকে, তাহলে তারা সদা বিজয় অর্জন করতে থাকবে। তবে সমস্যা হচ্ছে মুসলিমরা আনুগত্যের পথ ছেড়ে দেয়ার কারণে বিজয় ও সাহায্য তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সুতরাং গুনাহ ও পাপ কাজের মন্দ পরিণাম সম্পর্কে জানিয়ে দেয়ার জন্য ও ভাল কাজের শুভ পরিণাম সম্পর্কে অবগত করে দেয়ার জন্য এবং পরীক্ষা করার জন্য তাদের থেকে বিজয়কে সরিয়ে নিয়েছেন।
এত কিছুর পরও তিনি মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হাসান বসরী (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল- শত্রুকে মুসলমানদের উপর শক্তিশালী করে দেয়ার পর ক্ষমা করে দেয়া হল কিভাবে? উত্তরে তিনি বললেন- আল্লাহর ক্ষমা না হলে শত্রুরা তাদের মূলোৎপাটন করে ফেলত। তারা মুসলমানদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সুতরাং তাঁর ক্ষমার কারণেই এইবার তিনি শত্রুদেরকে প্রতিহত করেছেন।
এরপর আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলমানদের ঐ দৃশ্য ও অবস্থার আলোচনা করেছেন, যখন তারা পাহাড়ের উপর আরোহন করে পলায়ন করছিল। তারা আল্লাহর রসূল ও সাহাবীদের প্রতি ফিরেও তাকাচ্ছিলেন না। অথচ রসূল (সাঃ) পিছন দিক থেকে এই বলে ডাকছিলেন যে, হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা আমার দিকে ফিরে এসো। আমি আল্লাহর রসূল! সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের এই পলায়নের কারণে দুশ্চিন্তার পর দুশ্চিন্তায় ফেলার মাধ্যমে পরীক্ষা করেছেন। (এক) পলায়নের কারণে নেমে আসা বিষিণ্ণতা। (দুই) শয়তানের এই বলে চিৎকারের বিষণ্ণতা যে, সে বলেছিল মুহাম্মাদ (সাঃ) নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন- পলায়নের মাধ্যমে যেহেতু তারা রসূল (সাঃ) কে পেরেশানীর মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, তাই আল্লাহ্ তা‘আলাও তাদেরকে দুশ্চিন্তায় ফেলে পরীক্ষায় ফেলেছেন। তবে নিম্নলিখিত কারণে প্রথম কথাটিই অধিক সুস্পষ্ট: ১. আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻟِﻜَﻴْﻠَﺎ ﺗَﺤْﺰَﻧُﻮﺍ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﺎ ﻓَﺎﺗَﻜُﻢْ ﻭَﻟَﺎ ﻣَﺎ ﺃَﺻَﺎﺑَﻜُﻢْ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﺧَﺒِﻴﺮٌ ﺑِﻤَﺎ ﺗَﻌْﻤَﻠُﻮﻥَ
‘‘যাতে তোমরা হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া বস্ত্তর জন্য দুঃখ না কর এবং যার সম্মুখীন হচ্ছ সে জন্য বিষণ্ণ না হও। আর আল্লাহ্ তোমাদের কাজের ব্যাপারে অবহিত রয়েছেন’’।[3] এখানে মুসলমানদেরকে বিষণ্ণগ্রস্ত করার পর পুনরায় বিষণ্ণ করা হিকমত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যাতে তারা বিজয় হাত ছাড়া হওয়ার কারণে এবং পরাজিত হওয়ার কারণে আপতিত দুশ্চিন্তা ভুলে যায়। আর এটি ঐ রকম একটি পেরেশানী ঢেলে দেয়ার মাধ্যমেই সম্ভব, যার পরে আরেকটি পেরেশানী আগমন করেছিল।
২. প্রথম ব্যাখ্যাটিই বাস্তব সম্মত। তারা একাধিক পেরেশানীতে পড়েছিল। সেদিন গণীমতের মাল অর্জন না করতে পারার বিষণ্ণতা, পরাজিত হওয়ার বিষণ্ণতা, আহত ও নিহত হওয়ার বিষণ্ণতা, নাবী (সাঃ) নিহত হওয়ার গুজব এবং শত্রুদের পাহাড়ের উপর উঠে পড়া। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এখানে শুধু দু’টি পেরেশানী ছিলনা; বরং পেরেশানীর পর পেরেশানী আসতেই ছিল। যাতে করে তাদের ঈমানের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা হয়ে যায়।
৩. এখানে গাম্ম (পেরেশানী) দ্বারা সাজা ও শাস্তিকে পরিপূর্ণ করা হয়েছে। সাজা অর্জনের কারণ হিসাবে নির্ধারণ করা হয়নি। সার কথা হচ্ছে নাবী (সাঃ) কে বর্জন করা, যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করা, রসূলের ডাকে সাড়া না দেয়া, তাঁর কথা অমান্য করে তীরন্দাজদের স্থান ত্যাগ করা, পরস্পর মতবিরোধ করা এবং মনোবল হারা হয়ে যাওয়া- এগুলো এমন বিষয় যার প্রত্যেকটিই একটি করে পেরেশানী ডেকে আনে। সুতরাং পেরেশানীতে পড়ার একাধিক কারণ পাওয়া গিয়েছিল বলেই একের পর এক পেরেশানী এসেছিল। মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর অপার অনুগ্রহ ও দয়ার কারণেই তাদের থেকে এমন কিছু স্বভাবগত মন্দ আচরণ প্রকাশ হয়েছিল, যা স্থায়ী বিজয়ের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই এগুলো থেকে তাদেরকে পরিষ্কার করার জন্য এমন কিছু কারণ তৈরী করেছেন, যার ফলাফল বাহ্যিক দৃষ্টিতে খারাপ মনে হচ্ছিল। তখন তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, কৃত অপরাধ থেকে তাওবা করা, উপরোক্ত অপরাধগুলো জরুরী ভিত্তিতে পরিহার করা। আর পাপ কাজ ছেড়ে দিয়ে তার স্থলে নেক কাজ করা অত্যন্ত জরুরী। এ ছাড়া স্থায়ী সাহায্য ও বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়। সুতরাং উহুদ যুদ্ধের পর তারা সতর্ক হয়ে গেল এবং যেই দরজা দিয়ে পরাজয়ের কারণগুলো প্রবেশ করেছিল, তা সম্পর্কে অবগত হয়ে গেল। কেননা কখনও অসুস্থতার মাধ্যমেও শরীর সুস্থ হয়ে থাকে। অর্থাৎ পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার পর বান্দা যখন তাওবা করে তখন সে গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়। তার শরীর ও মন পূর্বের তুলনায় অধিক সুস্থতা অনুভব করে।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলিমদের উপর দয়া ও রহমত বশতঃ তাদের উপর নিদ্রা ঢেলে দিয়ে পেরেশানীকে দূর করে দিয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে নিদ্রা হচ্ছে বিজয়ের আলামত। বদরের যুদ্ধেও আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে তন্দ্রা ও নিদ্রা দিয়ে আচ্ছাদিত করেছিল। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- যার উপর নিদ্রা আগমণ করেনি, সে ঐ সমস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত যারা নিজেদের নফস্ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তার কাছে দ্বীন, নাবী বা সঙ্গী-সাথীর কোন মূল্য ছিলনা। আর তারা আল্লাহ্ সম্পর্কে জাহেলী যামানার লোকদের ধারণা পোষণ করেছিল।
আল্লাহর রসূল সম্পর্কে তাদের ধারণা কেমন ছিল- এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, তারা ধারণা করত যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে সাহায্য করবেন না। অচিরেই মুহাম্মাদের কর্ম-কান্ড ও প্রচেষ্টার অবসান ঘটবে। তারা আরও ধারণা করেছিল যে, তাদের যে বিপর্যয় হয়েছিল, তা আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর অনুযায়ী হয়নি। এতে আল্লাহর বিশেষ কোন হিকমতও ছিলনা। সুতরাং তারা কাদ্র (তাকদীর), হিকমতে ইলাহী এবং দ্বীনে ইলাহীর বিজয় হওয়ার কথা অস্বীকার করেছিল। এটিই ছিল তাদের মন্দ ধারণা। যেই ধারণা করেছিল মক্কার মুশরিক এবং মদ্বীনার মুনাফেকরা। সূরা ফাতাহ্-এর মধ্যে এ সবের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এই ধারণা ছিল একটি মন্দ ধারণা। কারণ এটি এমন একটি ধারণা, যা আল্লাহর যাতে পাক, তাঁর সুমহান নাম, গুণাবলী, তাঁর হিকমতের ক্ষেত্রে মোটেই ঠিক নয়। তেমনি এমন ধারণা আল্লাহর একচছত্র রুবুবীয়াত ও উলুহীয়াতের শানেও প্রযোজ্য নয়। কারণ আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং যে ধারণা করবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রিসালাতকে পূর্ণতা দান করবেন না, সত্যের উপর বাতিলকে সবসময় বিজয়ী রাখবেন, সত্য বাতিলের সামনে দুর্বল হয়ে থাকবে এবং এরপর সত্য কখনই মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবেনা, সে অবশ্যই আল্লাহর ব্যাপারে মন্দ ধারণা করল। সে আল্লাহর সাথে এমন বিষয়কে সম্পৃক্ত করল, যা আল্লাহর সিফাতে কামালিয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে ব্যক্তি ঐ প্রকারের কোন কর্মে তাকদীরে ইলাহীকে অস্বীকার করল সে আল্লাহর ক্ষমতা ও রাজত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আর যে সমস্ত লোক আল্লাহর সেই হিকমতকে অস্বীকার করল, যার কারণে তিনি প্রশংসার হকদার এবং এই ধারণা পোষণ করল যে, উহুদের যুদ্ধে আল্লাহ্ মুমিনদেরকে পরাজিত করতে চেয়েছেন বলেই তা করেছেন, এর পিছনে অন্য কোন হিকমত নিহিত নেই, তারা কাফেরদের ন্যায়ই ধারণা করল। আর কাফেরদের জন্যই রয়েছে ধ্বংস ও জাহান্নাম।
অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ্ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে থাকে। বিশেষ করে ঐ সমস্ত বিষয়ে, যা তাদের তাকদীরের সাথে সম্পৃক্ত। যারা আল্লাহর যাতে পাক, তাঁর পবিত্র নামসমূহ, তাঁর ত্রুটিমূক্ত সিফাতসমূহ এবং হিকমতসমূহ ও তিনিই যে যথাযথ প্রশংসার হকদার এ সম্পর্কে যারা অবগত, তারাই কেবল আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারনা করা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। যে মুমিন আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হল, সে আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল। যে ব্যক্তি এই বিশ্বাস পোষণ করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সৎ বান্দাদেরকে শাস্তি দিবেন এবং তাঁর বন্ধু ও শত্রুদের সাথে একই আচরণ করবেন, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল।
যে ব্যক্তি মনে করল যে, আল্লাহর বান্দারা তাঁর আদেশ-নিষেধের আওতাভুক্ত নয়, সেও আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি অসৎ ধারণা করল। এমনি কল্পনা করল যে, তিনি ভাল কাজের বিনিময়ে ছাওয়াব ও খারাপ কাজের বিনিময়ে শাস্তি দিবেন না এবং যে বিষয়ে মানুষেরা মতভেদ করছে, তাতে তিনি কিয়ামতের দিন ফয়সালা প্রদান করবেন না সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যারা বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা বিনা কারণেই বান্দার সৎকাজকে নষ্ট করে দিবেন এবং যেই কর্মে বান্দার কোন দোষ নেই, তার জন্যও তিনি বান্দাকে শাস্তি দিবেন অথবা আল্লাহ্ তা‘আলা সেই সমস্ত মুজেযা দ্বারা তাঁর শত্রুদেরকে শক্তিশালী করবেন, যেগুলো দ্বারা তিনি তাঁর রসূলদেরকে শক্তিশালী করেছেন এবং যে মনে করবে যে, আল্লাহ্ থেকে যা আসবে তার সবই একই রকম ভাল, এমন কি যে ব্যক্তি সারা জীবন আল্লাহর আনুগত্যে কাটিয়েছে, তাকে চিরকালের জন্য জাহান্নামে পাঠানো এবং যে ব্যক্তি সারা জীবন আল্লাহর নাফরমানীতে শেষ করেছে, তাকে জান্নাতে পাঠানোও আল্লাহর জন্য একই রকম উত্তম এবং উভয়টি একই রকম সুন্দর, যে ব্যক্তি ধারণা করল, ভাল-মন্দ- এ দু’টির মাঝে অহীর মাধ্যম ছাড়া পার্থক্য করা সম্ভব নয়, কারণ মানুষের বিবেক কোনটিকে মন্দ ও কোনটিকে সুন্দর সাব্যস্ত করতে সক্ষম নয়, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যে ব্যক্তি বিশ্বাস করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের সত্ত্বা, গুণাবলী এবং তাঁর কর্মসমূহ সম্পর্কে যেই সংবাদ দিয়েছেন, তার প্রকাশ্য অর্থ বাতিল এবং তা উপমা স্বরূপ। এখানে মূল সত্যকে সুস্পষ্ট করে উল্লেখ না করে ছেড়ে দিয়ে দূর থেকে তার দিকে ইশারা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি মনে করবে যে, কুরআন মজীদে সর্বদা অর্থহীন শব্দ ও উপমা পেশ করা হয়েছে, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল। যারা মনে করল, আল্লাহ্ চেয়েছেন যে, তাঁর বান্দারা স্বীয় কালামের অর্থ পরিবর্তন করুক এবং সেই অর্থ দ্বারা তাদের মসিত্মস্ককে পরিপূর্ণ করুক এবং তাঁর নাম ও গুণাবলীর পরিচয় জানার জন্য তিনি তাদেরকে বিবেকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন; তাঁর কিতাবের উপর নির্ভর করতে বলেন নি, তারাও আল্লাহর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করল। যারা মনে করে, আল্লাহ্ তাদেরকে স্বীয় কালামের সেই বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতে বলেন নি, যার প্রতি আরবী ভাষা সুস্পষ্ট নিদের্শনা প্রদান করে (অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা খোলাখুলিভাবে হক প্রকাশ করতে সম্পূর্ণ সক্ষম এবং ঐ সমস্ত শব্দ দূর করতে সক্ষম, যেগুলো মানুষকে বাতিল আকীদার দিকে নিয়ে যায়) তারাও আল্লাহর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করল।
যে ব্যক্তি বিশ্বাস করল যে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রসূল ব্যতীত সে এবং তার উস্তাদরাই সত্য বলেছেন এবং তাদের কথাতেই রয়েছে সুস্পষ্ট হিদায়াত ও আল্লাহর কালামের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণের মধ্যে গোমরাহী ছাড়া অন্য কিছু নেই, তাদের ধারণা আল্লাহর প্রতি খুবই মন্দ। এদের সকলেই আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণকারী এবং আল্লাহর ব্যাপারে অন্যায় ও জাহেলিয়াতের ন্যায় ধারণা পোষণকারী।
এমনি যে ধারণা করল যে, আল্লাহর রাজ্যে আল্লাহর ইচ্ছার বাইরেও অন্য কিছু সংঘটিত হয়ে থাকে এবং এমন কিছু হয়ে থাকে, যা তিনি সৃষ্টি করতে ও গঠন করতে সক্ষম নন সেও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল। যারা বিশ্বাস করল আল্লাহ্ তা‘আলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কর্মহীন ছিলেন, কোন কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষমও ছিলেন না, অতঃপর তিনি কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হয়েছেন, সেও আল্লাহর প্রতি খুব খারাপ বিশ্বাস পোষণ করল। যারা বিশ্বাস করল, আল্লাহ্ শুনেন না, দেখেনও না এবং সৃষ্টি সম্পর্কে অবগতও নন সেও আল্লাহর প্রতি খুব খারাপ ধারণা পোষণ করল। আর যারা মনে করে আল্লাহর কোন ইচ্ছা নেই, কথা বলাও তাঁর গুণের অন্তর্ভুক্ত নয়, তিনি কারও সাথে কথা বলেন নি, বলবেনও না, কোন আদেশ বা নিষেধও করেন নি, তারাও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যারা ধারণা করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা আসমানসমূহের উপর আরশে সমুন্নত নন, সকল স্থানই তাঁর জন্য সমান এবং যারা সুবহানা রাববীয়াল আ-লা আর সুবহানা রাববীয়াল আসফাল বলাকে একই রকম মনে করে তাদের আকীদাহ্ খুবই খারাপ। যারা মনে করে আল্লাহ্ তা‘আলা কুফরী পাপাচারিতা এবং অবাধ্যতাকে আনুগত্যের ন্যায়ই ভালবাসেন ও পছন্দ করেন তারাও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যারা বিশ্বাস করল যে, আল্লাহ্ কাউকে ভালবাসেন না, কারও প্রতি সন্তুষ্টও হন না, ক্রোধান্বিতও হন না, কাউকে বন্ধু হিসাবেও গ্রহণ করেন না, কাউকে দুশমন হিসাবেও গ্রহণ করেন না, তিনি কারও নিকটবর্তী হন না এবং অন্য কেউ তাঁর নিকটবর্তী হয়না, তারাও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণকারী।
এমনিভাবে যে ব্যক্তি মনে করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা পরস্পর বিরোধী দু’টি বিষয়কে একইভাবে মূল্যায়ন করেন এবং সকল দিক থেকে সমান দু’টি বস্ত্তর মধ্যে পার্থক্য করেন (অর্থাৎ ন্যায় বিচার বর্জন করেন) কিংবা একটি মাত্র কবীরা গুনাহ্এর কারণে সারা জীবনের সৎ আমল বরবাদ করে দেন এবং জাহান্নামে চিরস্থায়ী করেন, সেও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল।
সার কথা হচ্ছে, আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের জন্য যেই গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন অথবা আল্লাহর রসূল (সাঃ) আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র সত্তার জন্য যে সমস্ত গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন, কেউ যদি তার খেলাফ ধারণা পোষণ করে অথবা আল্লাহর গুণাবলীকে বাতিল বলে বিশ্বাস করে সেও আল্লাহর প্রতি খুব মন্দ ধারণা পোষণ করল।
চলমান.........
[1]. সূরা আল-ইমরান-০৩:১৭৯ [2]. সূরা তাওবা-৯:২৫-২৬ [3]. সূরা আল-ইমরান-৩: ১৫৩ http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=3934
------------------------------------------------------
বইঃ মুখতাসার যাদুল মা‘আদ , অধ্যায়ঃ অনুচ্ছেদ সমুহের সূচী ও বিবরন, অনুচ্ছেদঃ উহুদ যুদ্ধের শিক্ষা - দ্বিতীয় ভাগ
উহুদ যুদ্ধের শিক্ষা - দ্বিতীয় ভাগ
এমনিভাবে যারা বিশ্বাস করল যে, আল্লাহর সন্তান রয়েছে অথবা তাঁর কোন শরীক আছে অথবা আল্লাহর অনুমতি ব্যতীতই তাঁর কাছে কেউ সুপারিশ করতে পারবে অথবা আল্লাহর মাঝে এবং তাঁর মাঝে কোন মাধ্যম (মধ্যস্থতাকারী রয়েছে), যারা আল্লাহর কাছে মাখলুকের প্রয়োজন পেশ করে থাকে অথবা যে ধারণা করল যে, আল্লাহর কাছে যা আছে, তা আনুগত্যের মাধ্যমেও পাওয়া যাবে এবং নাফরমানীর মাধ্যমেও পাওয়া যাবে অথবা ধারণা করল যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন কাজ ছেড়ে দিলে আল্লাহ্ তা‘আলা তার বদলে অন্য কিছু দিবেন না অথবা ধারণা করল যে, পাপ কাজের ইচ্ছা করলেই বিনা কারণে বান্দাকে শাস্তি দিবেন অথবা যে ব্যক্তি ধারণা করল যে, অন্তরে ভয় ও আশা নিয়ে নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করলেও আল্লাহ্ তাকে নিরাশ করবেন অথবা ধারণা করল যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) এর শত্রুরা তাঁর জীবদ্দশায় কিংবা মৃত্যুর পর সর্বদা বিজয়ী থাকবে, তারাও আল্লাহর প্রতি খুব মন্দ ধারণা পোষণ করল।
যারা ধারণা করল যে, রসূল (সাঃ) মৃত্যু বরণ করার পর লোকেরা আহলে বাইতের উপর জুলুম করেছে এবং তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে, আল্লাহর দুশমন এবং আহলে বাইতের দুশমনদের বিজয় হয়েছে, অথচ আল্লাহ্ আহলে বাইতকে সাহায্য করার ক্ষমতাবান হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাদেরকে সাহায্য করেন নি এবং যারা ধারণা করে যে, যারা রসূল (সাঃ) এর অসীয়তকে পরিবর্তন করেছে, তাদেরকেই (আবু বকর ও উমার (রাঃ) ) তাঁর পাশে কবর দেয়া হয়েছে আর উম্মাতে মুহাম্মাদী তাঁর উপর এবং তাদের উপর সালাম পেশ করছে, তারা কাফের ও বাতিলপন্থী এবং আল্লাহর প্রতি খুবই খারাপ ধারণা পোষণকারী। কারণ আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা কুফরীরই নামান্তর।
সুতরাং অধিকাংশ লোকই আল্লাহর প্রতি অন্যায় ও খারাপ ধারণা পোষণ করে থাকে। যাদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলা তা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন সেই কেবল বাঁচতে পেরেছে। মানুষ মনে করে তাকে স্বীয় হক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, অথবা কমিয়ে দেয়া হয়েছে, সে মনে করে, আল্লাহ্ তাকে যা দিয়েছেন, সে তার চেয়ে আরও বেশী পাওয়ার হকদার ছিল, মুখে উচ্চারণ না করলেও তার অবস্থার ভাষা বলছে, আমার রব আমার উপর জুলুম করেছেন, আমার অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত রেখেছেন। তার নফস্ এই কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে। যদিও তার জবান তা অস্বীকার করছে। কেননা সে তা খোলাখুলি উচ্চারণ করতে সাহস পাচ্ছেনা। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজের নফসের মধ্যে অনুসন্ধান চালাবে, সে তাতে এই কথার সত্যতা খুঁজে পাবে। এই ধারণাটি তার মধ্যে সেভাবেই লুকিয়ে থাকে যেমন আগুন দিয়াশলাইয়ের মধ্যে লুকায়িত থাকে। সুতরাং তুমি যদি এ কথার সত্যতা যাচাই করতে চাও, তাহলে কারও দিয়াশলাইয়ে আঘাত করে দেখ (কোন মানুষকে পরীক্ষা করে দেখ)। অচিরেই সে তার ভিতরের অবস্থা কিছু হলেও প্রকাশ করে দিবে। তুমি দেখবে, সে তার তাকদীরের উপর আপত্তি উত্থাপন করছে, স্বীয় তাকদীরকে দোষারোপ করছে এবং তাকদীরে যা লিখিত হয়েছে, তার বিপরীত প্রস্তাব করছে। কেউ কম করছে আবার কেউ বেশী করছে। প্রত্যেকের উচিৎ নিজ নিজ নফ্সের খোঁজ-খবর নেওয়া এবং আত্মসমালোচনা করা। সে এই রেসূ থেকে মুক্ত কি না? কবির ভাষায় বলতে গেলেঃ
ﻓﺈﻥ ﺗﻨﺞُ ﻣﻨﻬﺎ ﺗﻨﺞُ ﻣﻦ ﺫﻱ ﻋﻈﻴﻤﺔ + ﻭﺇﻻ ﻓﺈﻧﻲ ﻻ ﺇﺧﺎﻟﻚ ﻧﺎﺟﻴﺎ
‘‘হে বন্ধু! তুমি যদি এ থেকে (তাকদীরের উপর আপত্তি করা থেকে) মুক্ত হয়ে থাক তাহলে জেনে রাখ তুমি বিরাট একটি মসীবত থেকে মুক্তি পেলে। এ থেকে মুক্তি না পেলে তুমি নাজাত পাবে বলে আমার মনে হয়না।
সুতরাং এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিরই উচিৎ নিজ নিজ আত্মার খবর নেওয়া, আত্মাকে উপদেশ দেয়া এবং প্রতিটি মুহূর্তেই আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা, দু’আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। তিনি যেন তাকে তাঁর প্রতি খারাপ ধারণা থেকে মাহফুজ রাখেন এবং সেই অনুযায়ী আমলে সালেহ করার তাওফীক দেন। আমীন।
অতঃপর আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণার বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। উহুদ যুদ্ধের দিন আল্লাহ্ তা‘আলা মুনাফেক ও দুর্বল ঈমানের অধিকারীদের প্রকৃত অবস্থা ফাঁস করে দিয়ে বলেন-
ﺛُﻢَّ ﺃَﻧْﺰَﻝَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِ ﺍﻟْﻐَﻢِّ ﺃَﻣَﻨَﺔً ﻧُﻌَﺎﺳًﺎ ﻳَﻐْﺸَﻰ ﻃَﺎﺋِﻔَﺔً ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﻭَﻃَﺎﺋِﻔَﺔٌ ﻗَﺪْ ﺃَﻫَﻤَّﺘْﻬُﻢْ ﺃَﻧْﻔُﺴُﻬُﻢْ ﻳَﻈُﻨُّﻮﻥَ ﺑِﺎﻟﻠﻪِ ﻏَﻴْﺮَ ﺍﻟْﺤَﻖِّ ﻇَﻦَّ ﺍﻟْﺠَﺎﻫِﻠِﻴَّﺔِ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﻥَ ﻫَﻞْ ﻟَﻨَﺎ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺄَﻣْﺮِ ﻣِﻦْ ﺷَﻲْﺀٍ ﻗُﻞْ ﺇِﻥَّ ﺍﻟْﺄَﻣْﺮَ ﻛُﻠَّﻪُ ﻟِﻠﻪِ ﻳُﺨْﻔُﻮﻥَ ﻓِﻲ ﺃَﻧْﻔُﺴِﻬِﻢْ ﻣَﺎ ﻟَﺎ ﻳُﺒْﺪُﻭﻥَ ﻟَﻚَ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﻥَ ﻟَﻮْ ﻛَﺎﻥَ ﻟَﻨَﺎ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺄَﻣْﺮِ ﺷَﻲْﺀٌ ﻣَﺎ ﻗُﺘِﻠْﻨَﺎ ﻫَﺎﻫُﻨَﺎ ﻗُﻞْ ﻟَﻮْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﻓِﻲ ﺑُﻴُﻮﺗِﻜُﻢْ ﻟَﺒَﺮَﺯَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻛُﺘِﺐَ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢُ ﺍﻟْﻘَﺘْﻞُ ﺇِﻟَﻰ ﻣَﻀَﺎﺟِﻌِﻬِﻢْ ﻭَﻟِﻴَﺒْﺘَﻠِﻲَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻣَﺎ ﻓِﻲ ﺻُﺪُﻭﺭِﻛُﻢْ ﻭَﻟِﻴُﻤَﺤِّﺺَ ﻣَﺎ ﻓِﻲ ﻗُﻠُﻮﺑِﻜُﻢْ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠِﻴﻢٌ ﺑِﺬَﺍﺕِ ﺍﻟﺼُّﺪُﻭﺭِ
‘‘অতঃপর তোমাদের উপর শোকের পর শান্তি অবতীর্ণ করলেন, যা ছিল তন্দ্রার মত। সে তন্দ্রায় তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ ঝিমোচ্ছিল আর কেউ কেউ প্রাণের ভয়ে (নিজের জীবনকে নিয়ে) ব্যস্ত ছিল। আল্লাহ্ সম্পর্কে তাদের মিথ্যা ধারণা হচ্ছিল মূর্খদের মত। তারা বলছিল আমাদের হাতে কি কিছুই করার নেই? তুমি বল, সবকিছুই আল্লাহর হাতে। তারা যা কিছু মনে লুকিয়ে রাখে-তোমার নিকট প্রকাশ করে না সে সবও। তারা বলে আমাদের হাতে যদি কিছু করার থাকতো, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতামনা। তুমি বল, তোমরা যদি নিজেদের ঘরেও থাকতে তথাপি যাদের ভাগ্যে মৃত্যু লিখা ছিল, তারা তাদের মৃত্যুশয্যা পানে বের হয়ে পড়ত। তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে, তার পরীক্ষা করা ছিল আল্লাহর ইচ্ছা, আর তোমাদের অন্তরে যা কিছু রয়েছে তা পরিষ্কার করা ছিল তার কাম্য। আল্লাহ্ মনের গোপন বিষয় জানেন’’।[1] আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণার কারণেই তারা বলেছিল- এ ব্যাপারে অর্থাৎ পরামর্শ দেয়া ও সিদ্বান্ত গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের হাতে কি কিছু করার ছিল? তারা আরও বলেছিল, উহুদ যুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্বান্ত গ্রহণে আমাদের হাতে যদি কিছু থাকত, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতামনা। এই কথার মাধ্যমে তারা তাকদীরকে অস্বীকার করছে। তারা যদি তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস করত, তাহলে তাদেরকে দোষারোপ করা হতনা এবং এই ভাবে জবাব দেয়া হতনাঃ আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- ﻗُﻞْ ﺇِﻥَّ ﺍﻟْﺄَﻣْﺮَ ﻛُﻠَّﻪُ ﻟِﻠﻪِ তুমি বল, সবকিছুই আল্লাহর হাতে। এ জন্যই অনেকেই বলেছেন- তারা যেহেতু বলেছিল, এ ব্যাপারে তাদের হাতে যদি কিছু করার থাকত, তাহলে তারা নিহত হতনা, তাই তাদের এ কথা তাকদীরকে মিথ্যা বলারই শামিল। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- সব কিছুই আল্লাহর হাতে। সুতরাং যা কিছু পূর্ব থেকেই তাকদীরে লিখিত আছে তাই হবে। যার ভাগ্যে নিহত হওয়া লিখিত আছে, সে ঘরে বসে থাকার ইচ্ছা করলেও যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে অবশ্যই নিহত হবে। এতে কাদরীয়া সম্প্রদায় তথা তাকদীরকে অস্বীকারকারীদের কড়া প্রতিবাদ করা হয়েছে।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের আরেকটি হিকমত হচ্ছে, তাদের অন্তরে যে ঈমান বা নিফাক লুকায়িত আছে, তা যাচাই ও পরীক্ষা করা। এতে মুমিনদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পাবে। আর মুনাফেক এবং যাদের অন্তর রেসূাক্রান্ত তাদের নিফাকী প্রকাশিত হয়ে যাবে। মুমিনদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন করাও উদ্দেশ্য ছিল। কেননা মানুষের অন্তরে কখনও কখনও নাফসানী খাহেশাত, কুস্বভাব ও প্রবৃত্তির চাহিদা, সামাজিক রসম-রেওয়াজ প্রীতি, শয়তানের প্ররোচনা এবং গাফেলতি প্রবেশ করে থাকে। এতে অন্তরসমূহ প্রভাবিত হয় এবং এগুলো পরিপূর্ণ ঈমানের পরিপন্থীও বটে। মুমিনগণ যদি সবসময় বিপদমুক্ত থাকে এবং সুখ-সাচ্ছন্দে জীবন-যাপন করে তাহলে, তাদের অন্তর নিফাকী ও গাফেলতী থেকে পবিত্র হবেনা। সুতরাং এই পরাজয়ের মাধ্যমে তাদের উপর রহম করা হয়েছে। এটি বিজয়ের নিয়ামাত দান করার সমতুল্য।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- যে সমস্ত খাঁটি মুমিন উহুদ যুদ্ধের দিন পলায়ন করেছিল, তারা তাদের পাপের কারণেই এমনটি করেছিল। শয়তান তাদেরকে এমন কাজের প্রতি উৎসাহিত করেছিল, যার মাধ্যমে শত্রুদের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল। কেননা বান্দার আমলসমূহ কখনও তার পক্ষের সৈনিক হয় আবার কখনও তার বিপক্ষের সৈনিকে পরিণত হয়। সুতরাং যে মুহূর্তে মুমিন বান্দা শত্রুর মুকাবেলা করতে সক্ষম, তখন যদি সে ময়দান ছেড়ে পলায়ন করে তখন সেই পলায়ন তার এমন আমলের কারণেই, যার প্রতি শয়তান প্ররোচিত করেছিল।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি মুসলমানদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কেননা তাদের এই পলায়ন নিফাকী বা রসূল (সাঃ) সত্য নাবী হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের কারণে ছিলনা। এটি হয়েছিল আকস্মিকভাবে। এটি হয়েছিল তাদের কৃত কর্মের কারণে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﺃَﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺃَﺻَﺎﺑَﺘْﻜُﻢْ ﻣُﺼِﻴﺒَﺔٌ ﻗَﺪْ ﺃَﺻَﺒْﺘُﻢْ ﻣِﺜْﻠَﻴْﻬَﺎ ﻗُﻠْﺘُﻢْ ﺃَﻧَّﻰ ﻫَﺬَﺍ ﻗُﻞْ ﻫُﻮَ ﻣِﻦْ ﻋِﻨْﺪِ ﺃَﻧْﻔُﺴِﻜُﻢْ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻋَﻠَﻰ ﻛُﻞِّ ﺷَﻲْﺀٍ ﻗَﺪِﻳﺮٌ
‘‘যখন তোমাদের উপর একটি মসীবত এসে পৌঁছাল, অথচ তোমরা তার পুর্বেই দ্বিগুণ কষ্টে পৌঁছে গিয়েছ, তখন কি তোমরা বলবে, এটা কোথা থেকে এল? তাহলে বলে দাও, এ কষ্ট তোমাদের উপর পৌঁছেছে তোমাদেরই পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ প্রত্যেক বিষয়ের উপর ক্ষমতাশীল’’। (সূরা আল-ইমরান-৩: ১৬৫)
মুসলমানদের বিপদাপদ ও কষ্টে নিপতিত হওয়ার বিষয়টি মক্কী সূরসূমূহে আরও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻣَﺎ ﺃَﺻَﺎﺑَﻜُﻢْ ﻣِﻦْ ﻣُﺼِﻴﺒَﺔٍ ﻓَﺒِﻤَﺎ ﻛَﺴَﺒَﺖْ ﺃَﻳْﺪِﻳﻜُﻢْ ﻭَﻳَﻌْﻔُﻮ ﻋَﻦْ ﻛَﺜِﻴﺮٍ
‘‘তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ্ ক্ষমা করে দেন’’। (সূরা শুরা-৪২:৩০) আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-
ﺃَﻳْﻨَﻤَﺎ ﺗَﻜُﻮﻧُﻮﺍ ﻳُﺪْﺭِﻛُﻜُﻢُ ﺍﻟْﻤَﻮْﺕُ ﻭَﻟَﻮْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﻓِﻲ ﺑُﺮُﻭﺝٍ ﻣُﺸَﻴَّﺪَﺓٍ ﻭَﺇِﻥْ ﺗُﺼِﺒْﻬُﻢْ ﺣَﺴَﻨَﺔٌ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﺍ ﻫَﺬِﻩِ ﻣِﻦْ ﻋِﻨْﺪِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﺇِﻥْ ﺗُﺼِﺒْﻬُﻢْ ﺳَﻴِّﺌَﺔٌ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﺍ ﻫَﺬِﻩِ ﻣِﻦْ ﻋِﻨْﺪِﻙَ ﻗُﻞْ ﻛُﻞٌّ ﻣِﻦْ ﻋِﻨْﺪِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻓَﻤَﺎﻝِ ﻫَﺆُﻟَﺎﺀِ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡِ ﻟَﺎ ﻳَﻜَﺎﺩُﻭﻥَ ﻳَﻔْﻘَﻬُﻮﻥَ ﺣَﺪِﻳﺜًﺎ
‘‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন; মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই- যদি তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের ভিতরেও অবস্থান কর, তবুও। বস্ত্তত তাদের কোন কল্যাণ সাধিত হলে তারা বলে যে, এটা সাধিত হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর যদি তাদের কোন অকল্যাণ হয়, তবে বলে, এটা হয়েছে তোমার পক্ষ থেকে, বলে দাও, এ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। তবে তাদের কী হল যে, তারা কখনও কোন কথা বুঝতে চেষ্টা করেনা’’। (সূরা নিসা-৪:৭৮) সুতরাং নিয়ামত অর্জিত হলে তা আল্লাহর ফজল ও করমের ফলেই হয়ে থাকে।
আর মসীবত নাজিল হলে তাঁর পক্ষ হতে ন্যায় বিচার ও ইনসাফের কারণেই হয়ে থাকে। পরিশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻋَﻠَﻰ ﻛُﻞِّ ﺷَﻲْﺀٍ ﻗَﺪِﻳﺮٌ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ প্রত্যেক বিষয়ের উপর ক্ষমতাশীল’’। (সূরা আল-ইমরান-৩:১৬৫) তার আগে তিনি বলেন- যে মসীবতে তোমরা পড়েছ, তা তোমাদের হাতের কামাই। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইনসাফের সাথে আল্লাহ্ তা‘আলার ক্ষমতা অত্যন্ত ব্যাপক। এখানে তাকদীর তথা ভাগ্যের লিখন এবং বান্দার প্রচেষ্টা- উভয়টি সাব্যস্ত করা হয়েছে। আমল ও চেষ্টার নিসবত (সম্বন্ধ) করা হয়েছে বান্দাদের দিকে এবং কুদরত তথা ক্ষমতার নিসবত (সম্বন্ধ) করা হয়েছে আল্লাহর দিকে। এখানে জাবরীয়া সম্প্রদায় অর্থাৎ যারা বলে, বান্দা যা কিছু করে তার সবই আল্লাহর পক্ষ হতেই হয়ে থাকে। তাতে বান্দার কোন হাত নেই। বান্দা কাঠের পুতুলের ন্যায় এবং শিশুর হাতে লাটিমের ন্যায়। শিশু লাটিম যেভাবে ঘুরায়, লাটিম সেভাবেই ঘুরে। বান্দার বিষয়টিও একই রকম। আল্লাহ্ তাকে যেভাবে চালান, সেভাবেই চলে। বান্দার কোন স্বাধীনতা নেই। সুতরাং ভাল-মন্দ সবই আল্লাহর পক্ষ হতে।
সেই সাথে এখানে কাদরীয়া সম্প্রদায় অর্থাৎ যারা তাকদীরকে অস্বীকার করে তাদেরও প্রতিবাদ করা হয়েছে। কাদরীয়াদের পরিচয় হল, তারা বলে বান্দার ভাল-মন্দ সকল কাজে বান্দা স্বাধীন। তাতে আল্লাহর কোন হাত নেই। এমন কি বান্দা কাজটি করার আগে আল্লাহ্ তা‘আলা জানতেও পারেন না।
কুরআন ও হাদীছের দলীল উপরোক্ত দলটির কঠোর প্রতিবাদ করেছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻟِﻤَﻦْ ﺷَﺎﺀَ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﺃَﻥْ ﻳَﺴْﺘَﻘِﻴﻢَ ﻭَﻣَﺎ ﺗَﺸَﺎﺀُﻭﻥَ ﺇِﻟَّﺎ ﺃَﻥْ ﻳَﺸَﺎﺀَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺭَﺏُّ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴﻦَ
‘‘ তার জন্যে, যে তোমাদের মধ্যে সোজা পথে চলতে চায়। তোমরা আল্লাহ্ রাববুল আলামীনের অভিপ্রায়ের বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পারনা’’। (সূরা তাকভীর-৮১:২৮-২৯) উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের যেই কষ্ট হয়েছিল তার দিকে ইঙ্গিত প্রদান করে নাযিলকৃত আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলার কুদরত (ক্ষমতার) উল্লেখ করার মধ্যে একটি সুক্ষ্ম বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে উহুদ যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের বিষয়টি সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। সুতরাং এ বিষয়ে আল্লাহ্ যা বলেছেন, তা ব্যতীত অন্য কারও কাছে ব্যাখ্যা তলব করা ঠিক নয়। অন্য আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻣَﺎ ﺃَﺻَﺎﺑَﻜُﻢْ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﺘَﻘَﻰ ﺍﻟْﺠَﻤْﻌَﺎﻥِ ﻓَﺒِﺈِﺫْﻥِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﻟِﻴَﻌْﻠَﻢَ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﻭَﻟِﻴَﻌْﻠَﻢَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻧَﺎﻓَﻘُﻮﺍ
‘‘আর যেদিন দু’দল সৈন্যের মোকাবিলা হয়েছে; সেদিন তোমাদের উপর যা আপতিত হয়েছে তা আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে এবং তা এজন্য যে, যাতে ঈমানদারদেরকে জানা যায়’’। (সূরা আল-ইমরান-৩:১৬৬-১৬৭) এখানে আল্লাহুর হুকুমেই উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয় হয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর হুক্মে তাকভীনি বা তাকদীরী। অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টিগত হুকুম উদ্দেশ্য। যেই হুকুমের মাধ্যমে তিনি সকল বস্ত্ত সৃষ্টি করেছেন। শরীয়তের হুকুম উদ্দেশ্য নয়।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদেরকে পরাজিত করার মাধ্যমে খাঁটি মুমিনদেরকে জানতে চেয়েছেন এবং মুনাফেকদেরকে মুসলমানদের থেকে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য করতে চেয়েছেন। এর মাধ্যমে মুনাফেকরা তাদের অন্তরের গোপন বিষয় বের করে দিয়েছিল। মুমিনগণ তা শুনেও ফেলল এবং তারা আল্লাহ্ তা‘আলা কিভাবে তাদের জবাব দিয়েছেন তাও শুনতে পেল। সেই সাথে মুনাফেকদের ষড়যন্ত্র ও তার পরিণাম সম্পর্কেও জানা হয়ে গেল।
সুতরাং উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের ঘটনার মধ্যে যে কত হিকমত, নিয়ামাত ও উপদেশ নিহিত আছে, তার প্রকৃত হিসাব আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানে না।
পরিশেষে উহুদ যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবী শাহাদাত বরণ করার কারণে মুসলমানদের অন্তরে যেই আঘাত লেগেছিল তা দূর করার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে অত্যন্ত উত্তম ভাষায় শান্তনা দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻟَﺎ ﺗَﺤْﺴَﺒَﻦَّ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻗُﺘِﻠُﻮﺍ ﻓِﻲ ﺳَﺒِﻴﻞِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺃَﻣْﻮَﺍﺗًﺎ ﺑَﻞْ ﺃَﺣْﻴَﺎﺀٌ ﻋِﻨْﺪَ ﺭَﺑِّﻬِﻢْ ﻳُﺮْﺯَﻗُﻮﻥَ ﻓَﺮِﺣِﻴﻦَ ﺑِﻤَﺎ ﺁَﺗَﺎﻫُﻢُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻣِﻦْ ﻓَﻀْﻠِﻪِ ﻭَﻳَﺴْﺘَﺒْﺸِﺮُﻭﻥَ ﺑِﺎﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻟَﻢْ ﻳَﻠْﺤَﻘُﻮﺍ ﺑِﻬِﻢْ ﻣِﻦْ ﺧَﻠْﻔِﻬِﻢْ ﺃَﻟَّﺎ ﺧَﻮْﻑٌ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﻭَﻟَﺎ ﻫُﻢْ ﻳَﺤْﺰَﻧُﻮﻥَ ﻳَﺴْﺘَﺒْﺸِﺮُﻭﻥَ ﺑِﻨِﻌْﻤَﺔٍ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﻓَﻀْﻞٍ ﻭَﺃَﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻟَﺎ ﻳُﻀِﻴﻊُ ﺃَﺟْﺮَ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺍﺳْﺘَﺠَﺎﺑُﻮﺍ ﻟِﻠﻪِ ﻭَﺍﻟﺮَّﺳُﻮﻝِ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِ ﻣَﺎ ﺃَﺻَﺎﺑَﻬُﻢُ ﺍﻟْﻘَﺮْﺡُ ﻟِﻠَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﺣْﺴَﻨُﻮﺍ ﻣِﻨْﻬُﻢْ ﻭَﺍﺗَّﻘَﻮْﺍ ﺃَﺟْﺮٌ ﻋَﻈِﻴﻢٌ
‘‘আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করোনা। বরং তাঁরা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত। আল্লাহ্ নিজের অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তার প্রেক্ষিতে তারা আনন্দ উদ্যাপন করছে। আর যারা এখনও তাদের কাছে এসে পৌঁছেনি তাদের পেছনে তাদের জন্য আনন্দ প্রকাশ করে। কারণ, তাদের কোন ভয়-ভীতিও নেই এবং কোন চিন্তা-ভাবনা নেই। আল্লাহর নিয়ামাত ও অনুগ্রহের জন্য তাঁরা আনন্দ প্রকাশ করে এবং তা এভাবে যে, আল্লাহ্ ঈমানদারদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না। যারা আহত হওয়ার পরেও আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের নির্দেশ মান্য করেছে, তাদের মধ্যে যারা সৎ ও মুত্তাকী, তাদের জন্য রয়েছে মহান ছাওয়াব।[2] আল্লাহ্ তা‘আলা এই আয়াত সমূহে শহীদদের জন্য চিরস্থায়ী জিন্দিগী, আল্লাহর নৈকট্য প্রদান, অবিরাম রিযিক চালু রাখার ঘোষণা করেছেন। তাই শহীদগণ আল্লাহর অনুগ্রহ পেয়ে অত্যন্ত খুশী ও সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাদের যে সমস্ত মুসলমান ভাই শহীদ হয়ে এখনও তাদের সাথে মিলিত হয় নি, পরবর্তীতে তারা শহীদ হয়ে এসে তাদের সাথে মিলিত হওয়ার সুসংবাদ শুনেও তারা আনন্দিত হয়। তাদের আনন্দ, নিয়ামাত, এবং সুসংবাদ প্রতি মুহূর্তে তাদের জন্য বর্ধিত সম্মান প্রাপ্তির মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করবে।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয়ের বিনিময়ে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা অফুরন্ত নিয়ামাত প্রদানের কথা উল্লেখ করেছেন। যেই নিয়ামাতগুলোর তুলনায় উহুদ যুদ্ধের মসীবত খুবই সামান্য। নিয়ামাতগুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করলে উহুদ যুদ্ধে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে মুসলমানদের কষ্টের অসিত্মত্বই খুঁজে পাওয়া যাবেনা। সেই নেয়ামতগুলোর অন্যতম হচ্ছে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের মধ্য হতেই একজন রসূল পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের নিকট আল্লাহর আয়াত পাঠ করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন, আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাত শিক্ষা দেন এবং গোমরাহীর অন্ধকার থেকে হিদায়াতের (আলোর) দিকে বের করেন। এই বিরাট কল্যাণের পর সকল বালা-মসীবত খুবই নগণ্য। আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেছেন যে, এই মসীবতের কারণ স্বয়ং মুসলিমরাই। যাতে তারা আগামীতে সংশোধন হয়ে যায় এবং সাবধানতা অবলম্বন করে। আর তাদের এই পরাজয় পূর্ব নির্ধারিত তাকদীর অনুযায়ীই হয়েছিল। সুতরাং তাদের উচিৎ সবসময় এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না করা। আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের হিকমতগুলো এই জন্যই বলে দিয়েছেন, যাতে তারা আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করে এবং সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর হিকমতের উপর ইয়াকীন রাখে এবং আল্লাহর উপর কোন প্রকার খারাপ ধারণা পোষণ থেকে বিরত থাকে। সেই সাথে যাতে করে তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার আসমায়ে হুসনা ও সিফাতে কামালিয়াতের মারেফতও হাসিল হয়ে যায়।
পরিশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে শান্তনা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, তিনি তাদেরকে এমন জিনিষ দিয়ে সম্মানিত করেছেন, যা বিজয় ও গণীমতের চেয়ে অনেক বড়। আর তা হচ্ছে শাহাদাতের মর্যাদা। এভাবে শান্তনা দেয়ার কারণ হচ্ছে, যাতে তারা তা পাওয়ার জন্য প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয় এবং যারা নিহত হয়েছে তাদের জন্য চিন্তিত না হয়। সুতরাং এর জন্য আমরা আল্লাহর সেরকমই প্রশংসা করছি, যেমন প্রশংসা তিনি পাওয়ার হকদার।
[1]. সূরা আল-ইমরান-৩:১৫৪ [2].সূরা আল-ইমরান-৩:১৬৯-১৭২
ওহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় বদর যুদ্ধের এক বছর পর অর্থাৎ তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে। ওহুদ একটি পর্বতের নাম। এই পর্বতের সম্মুখস্থ ময়দানে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় বলে এর নাম ওহুদ যুদ্ধ। নবুওয়াতির পূর্বে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মক্কাবাসীদের অতি আদরণীয় ও প্রিয় মিত্র। কিন্তু নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তিনি যে মুহূর্তে আল্লাহর উপর বিশ্বাস আনার জন্য মক্কাবাসীদের প্রতি আহ্বান জানান, তখন থেকেই তিনি তাদের ঘোরতর শত্রুরূপে বিবেচ্য হলেন এবং তার উপর চলল অমানুষিক নির্যাতন আর নিষ্পেষণের ষ্টিম রোলার। যার ফলশ্রুতিতে পরম করুণাময় আল্লাহ তা’আলার ইঙ্গিতে তাকে মদীনায় হিজরত করতে হয়। হিজরতের পর ধৈর্য্য-সহ্যের প্রতিকৃতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়। পড়ে পড়ে মার খাওয়া নয়- “ঔষধে কাজ না হলে অস্ত্রোপাচার” অভ্যুদয় ঘটে ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদের। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রা. এর মতে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ ১৯টি জিহাদে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন (মতান্তরে ২১, ২৪, ২৭ টি জিহাদে)।
তৃতীয় হিজরীতে ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। একে আলাদা যুদ্ধ না বলে ‘বদর যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়’ বা ধারাবাহিকতা বলেও আখ্যায়িত করা যায়। কেননা বদর যুদ্ধে মক্কাবাসী কুরাইশরা যে আঘাত পায় তার প্রতিশোধ গ্রহণের অগ্নিময় মনোবৃত্তিই ওহুদ যুদ্ধের মূল কারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সংঘটিত বড় যুদ্ধসমূহের মধ্যে ওহুদ যুদ্ধ অন্যতম প্রধান। এই যুদ্ধে মুসলমানগণ যে পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আল্লাহর তরফ থেকে পরীক্ষিত হয়েছিলেন, সমকালীন আর কোন যুদ্ধে তা হয়নি। এ কারণেই ইসলামের ইতিহাসে এই যুদ্ধ একটি শিক্ষণীয় মডেল হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।
এই যুদ্ধে কুরাইশদের ছিল প্রচুর রণসম্ভারে সমৃদ্ধ তিন হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী। বাহিনীর সামনে ছিল হোবল ঠাকুরের বিরাট এক মূর্তি আর এর পিছনে উষ্টপৃষ্টে আরোহিত রণরঙ্গিনী হিংস্র রমণীগণ রণসংগীত গেয়ে চলছিল কুরাইশ সৈন্যদের উত্তেজিত করতে। পক্ষান্তরে মুসলমানরা যখন যুদ্ধের জন্যে যাত্রা করেছিল, তখন তাদের সংখ্যা ছিল এক হাজারের মতো। এরপরও কিছুদূর গিয়ে তিন শ’ মুনাফিক আলাদা হয়ে গেল। এবার বাকী থাকলো শুধু সাত শ’ মুসলমান। তদুপরি যুদ্ধের সামানপত্র ছিল কম এবং এক তৃতীয়াংশ সৈন্যও গেল বিচ্ছিন্ন হয়ে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে কিছু লোকের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। এ সময় শুধু আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তার সাহায্যের ওপর ভরসাই মুসলমানদেরকে দুশমনদের মুকাবেলায় এগিয়ে নিয়ে চললো। এ উপলক্ষে হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে যে শান্তনা প্রদান করেন, আল্লাহ তা নিম্নোক্ত ভাষায় উল্লেখ করেছেন-
‘স্মরণ করো, যখন তোমাদের দুটি দল সাহস হারাবার উপক্রম হলো, অথচ আল্লাহ তাদের সাহায্যকারী ছিলেন, আর আল্লাহর উপরই ভরসা করা মুমিনদের উচিত। বস্তুতঃ আল্লাহ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। কাজেই আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো। আপনি যখন বলতে লাগলেন মুমিনগণকে- তোমাদের জন্য কি যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের সাহায্যার্থে তোমাদের পালনকর্তা আসমান থেকে অবতীর্ণ তিন হাজার ফেরেশতা পাঠাবেন। অবশ্য তোমরা যদি সবর কর এবং বিরত থাক আর তারা যদি তখনই তোমাদের উপর চড়াও হয়, তাহলে তোমাদের পালনকর্তা চিহ্নিত ঘোড়ার উপর পাঁচ হাজার ফেরেশতা তোমাদের সাহায্যে পাঠাতে পারেন। বস্তুতঃ এটা তো আল্লাহ তোমাদের সুসংবাদ দান করলেন, যাতে তোমাদের মনে এতে শান্তনা আসতে পারে। আর সাহায্য শুধুমাত্র পরাক্রান্ত, মহাজ্ঞানী আল্লাহরই পক্ষ থেকে।’ [সূরা আলে ইমরান : ১২২-১২৬]
৬২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি, তৃতীয় হিজরীর ১১ শাওয়াল (মতান্তরে ১৫ শাওয়াল) শনিবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহুদের ময়দানে পৌঁছেন। স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিরাট শত্রুবাহিনীর মুখোমুখী হতে হবে বিধায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি সূক্ষ কৌশল অবলম্বন করলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা. এর নেতৃত্বে পঞ্চাশ জনের একটি তীরান্দাজ বাহিনী সংকীর্ণ গিরিসংকুল পথে মোতায়েন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর হুঁশিয়ারী দিলেন, যাতে তারা যেন কোন অবস্থাতেই উক্ত স্থান পরিত্যাগ না করে, যদিও বা বাকী সৈন্যরা এমনকি তিনি স্বয়ং শহীদও হন। কেননা তাদের সামান্য অনুপস্থিতির সুযোগে পিছন দিক থেকে শত্রু সৈন্যদের আক্রমণের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা ছিল।
আক্রমণ শুরু হল। কাফেরদের পক্ষ থেকে তালহা প্রচণ্ড দম্ভভরে মুসলমানদের কটাক্ষ করতে করতে ময়দানে নামা মাত্রই শেরে খোদা হযরত আলী রা. তরবারির এক আঘাতে তাকে দ্বিখণ্ডিত করে তার দম্ভের জবাব দিলেন। অতঃপর তালহার পুত্র ওসমান অগ্রসর হলে মহাবীর হামজা রা. তদ্রুপ জবাব দিলেন।
এরপর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মুসলিম বাহিনী আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে শত্রু নিধন করতে করতে অগ্রসর হতে থাকে, আর শত্রুপক্ষ বিপর্যস্ত হয়ে পিছনে হটতে থাকে; এমনকি উত্তেজনা সৃষ্টিকারী নারী বাহিনী তাদের রণসংগীত ভঙ্গ করে পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকে। রণাঙ্গণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুপ্রেরণায় যে মুহূর্তে মুসলমানদের বিজয় সুনিশ্চিত হয়ে ওঠেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে আকস্মাৎ যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল, জয়-পরাজয়ে পরিবর্তন ঘটে গেল।
দুর্ভাগ্যক্রমে মুসলমানরা এ বিজয় ধরে রাখতে পারলেন না। আল্লাহর উপর সুগভীর বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে দৃঢ় চিত্ততায় একতাবদ্ধ হয়ে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করে বিজয় যখন হাতের মুঠোয় এবং কুরাইশরা প্রচণ্ড মার খেয়ে যখন পশ্চাদ্ধাবনরত; ঠিক সেই সময়ে মুসলমানদের এক অংশ বিজয় হয়েছে ভেবে গনিমতের মাল সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে পেছন দিক থেকে শত্রুর আক্রমণকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য যে তীরান্দাজ বাহিনীকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর হুঁশিয়ারী দিয়েছিলেন, যেন তারা কোন অবস্থাতেই এই নির্ধারিত স্থান ত্যাগ না করে, তারাও অন্যদের অনুসরণ করে গিরি-উপত্যকা ত্যাগ করে শত্রুপক্ষের ফেলে যাওয়া মাল সংগ্রহে লিপ্ত হয়ে যায়। খালিদ বিন অলীদ তখন কাফির সৈন্যদের একজন অধিনায়ক। সে এই সুবর্ণ সুযোগ কে পুরোপুরি কাজে লাগানো এবং পাহাড়ের পেছন দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে সুড়ঙ্গ-পথে মুসলমানদের ওপর হামলা করলো। হযরত আবদুল্লাহ এবং তার ক’জন সঙ্গী শেষ পর্যন্ত সুড়ঙ্গ পথের প্রহরায় ছিলেন, তাদের অধিকাংশই এই হামলার মুকাবেলা করলেন। কিন্তু কাফের দের এই প্রচণ্ড হামলাকে তারা প্রতিহত করতে পারলেন না। তারা শহীদ হয়ে গেলেন। অতঃপর দুশমনরা একে একে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওদিকে যে সব পলায়নপর কাফির দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিল, তারাও আবার ফিরে এলো। এবার দুদিক দিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলা শুরু হলো। এই অভাবিত পরিস্থিতিতে মুসলমানদের মধ্যে এমন আতঙ্কের সঞ্চার হলো যে, যুদ্ধের মোড়ই সম্পূর্ণ ঘুরে গেলো। মুসলমানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক পালাতে লাগলেন।
এতদসত্তেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দলীয় সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ না করে আক্রমণ প্রতিহত করার আহ্বান জানান। কিন্তু শত্রুপক্ষের প্রচণ্ড আক্রমণের কারণে তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। তথাপি তারা থেমে থাকেননি। পর্যায়ক্রমে এক একজন বীর সেনানী অগ্রসর হয়ে শত্রুপক্ষের সৈন্যকে পিছনে হটাতে থাকে। এ সময় রণাঙ্গনে গুজব রটে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহীদ হয়েছেন। এই একটি খবরে যুদ্ধরত দু’শিবিরে দু’ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শহীদ হওয়ার খবরে মুসলিম বাহিনী বে-পরোয়াভাবে শত্রুর মোকাবেলায় তৎপর হয়ে ওঠে। তারা ভাবলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি বেঁচে না থাকেন তাহলে আমাদের বেঁচে থাকার যুক্তি নেই। তার চাইতে শাহাদত বরণই শ্রেয়। অন্যদিকে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাহাদতকে বিজয় মনে করে যুদ্ধ চালনা অনাবশ্যক মনে করল। তদুপরি সংখ্যায় নগণ্য হলেও মুসলমানদের প্রতিরোধের মুখে কুরাইশ বাহিনী মদীনার দিকে অগ্রসর না হয়ে পিছনে ফিরে মক্কার দিকে চলল এবং তাদের নেতা আবু সুফিয়ান হুমকি দেয় “আমি প্রতিশোধ নিয়েছি, আগামী বছর নতুন করে বদর প্রান্তরে তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে।”
ওহুদ যুদ্ধে কারা জয়ী হয়েছে- তা সত্যিই বিতর্কিত। কেননা বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় মুসলমানদেরই পরাজয় হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের পরাজয় ঘটেনি বরং হয়েছে অর্জন। সে সম্পর্কিত কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো-
০১. নেতার আদেশ মান্য করলে তা হয় কল্যাণকর আর লংঘন করলে অকল্যাণ বয়ে আনে, তা মুসলমানগণ যুগপৎভাবে অনুধাবন করেছিলেন। যার ফলে ভবিষ্যতে আর এর পুনারাবৃত্তি ঘটেনি।
০২. পার্থিব লোভ-লালসার কারণে নিজ সম্পদও যে হাতছাড়া হয়ে যায় ওহুদের যুদ্ধ এই শিক্ষাই দেয়।
০৩. এই যুদ্ধে মুসলমানগণ বহু আকাংখিত শাহাদতের মৃত্যু লাভের সুযোগ পান।
০৪. কারা প্রকৃত মুসলিম আর কারা মুনাফিক তা ওহুদ রণাঙ্গন থেকেই স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়।
০৫. বিজয় অর্জনের চাইতে তা ধরে রাখা যে অধিকতর কঠিন ও সুফল দায়ক এবং এ লক্ষ্যে যুদ্ধ জয়ের পূর্বদিন অপেক্ষা পরের দিন বেশি সতর্কতাবস্থায় থাকতে হয়, এ যুদ্ধ থেকে মুসলমানগণ এই শিক্ষা অর্জন করেন।
০৬. নিরবছিন্ন বিজয় কোন জাতির ভাগ্যেই আসে না। জয়-পরাজয়, সুখ-দুঃখ, জাগতিক জীবনে অবশ্যম্ভাবী এবং ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে যে এসবের মোকাবেলা করতে হয় এ শিক্ষাও তারা এখান থেকে পান।
০৭. ‘দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় না মহীতে’। অনায়াসলব্ধ বস্তুর কদর অপেক্ষাকৃত কম। এরূপ প্রাপ্তি অলসতার জন্ম দেয়। কাজেই ওহুদ যুদ্ধের দুর্লভ প্রাপ্তি পরবর্তী বিজয়সমূহের পথ সুগম করে দেয়।
০৮. আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছা- ‘কাফিররা ধ্বংস হোক মুসলমানদের মোকাবেলায়’। কাজেই প্রতি যুদ্ধেই যদি কাফেররা পরাজিত হয় তাহলে তো তারা সম্মুখ সমরে না এসে দূর থেকে অথবা লুক্কায়িত থেকে ইসলামের অনিষ্ট সাধন করতে থাকবে। এ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে ওহুদের পরাজয় বিফলে যায়নি।
০৯. সাহাবীগণের ন্যায় অতুলনীয় ভক্তবৃন্দকে প্রতিনিয়ত বিশেষ বিশেষ সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে পরবর্তী জীবনে এবং সে সব সংকটকালে তাঁদের কি করণীয় তার শিক্ষা নেয়ার সুযোগ হয়েছিল ওহুদ রণাঙ্গণের অংশ বিশেষ থেকে।
১০. ব্যর্থতায় বিমর্ষতা আর সাফল্যে অতি হর্ষোৎফুল্লতা যে অকল্যাণ বয়ে আনে এর প্রমাণ ওহুদ যুদ্ধ।
১১. ওহুদ যুদ্ধে সত্তর জন মুসলিম শহীদ হন, কিন্তু কেউ-ই বন্দী হননি। পক্ষান্তরে বদর যুদ্ধে কাফেরদের সত্তর জন নিহত ও সত্তর জন বন্দী হয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে প্রশ্ন- কুরাইশরা কি আদৌ জয় লাভ করেছিল?
১২. বিজয়ের মূল্যায়ন সম্মুখ পানে অগ্রসর হওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে কুরাইশরা পেছন দিকে অর্থাৎ মক্কার দিকে রওয়ানা দেয়। পক্ষান্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ওহুদের ময়দানে তিনদিন অবস্থান করে শহীদদের দাফন-কাফনসহ বহু প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করেন।
১৩. কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের হুমকি- “আমি প্রতিশোধ নিয়েছি, আগামী বছর নতুন করে বদর প্রান্তরে তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে।” এটা কোন ক্রমেই বিজেতার উক্তি হতে পারে না।
১৪. মুসলিমরা যদি পরাজিতই হবে, তাহলে কুরাইশরা মদীনা দখল না করেই ফিরে যাবে কেন?
পরিশেষে, যদিও ঐতিহাসিকগণ ওহুদের জয়-পরাজয়ের বিষয়টি বিতর্কিত বলে আখ্যায়িত করেছেন, তথাপি উপরের আলোচনার আলোকে এটাকে মুসলিমদের পরাজয় বা কুরাইশদের নিরঙ্কুশ বিজয় বলে ধরে নেয়া যায় না। একথা ঠিক যে, এই যুদ্ধে মুসলমানগণ যথেষ্ট ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আল্লাহর তরফ থেকে পরীক্ষিত হয়েছিলেন। সোনা যেমন আগুনে পুড়ে খাঁটি হয়, তেমনি মুসলমানগণ এই যুদ্ধ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে খাঁটি সোনায় রূপান্তরিত হন। কাজেই ওহুদ যুদ্ধের প্রাপ্তি ন্যূনতম হলেও অন্তর্নিহিত প্রাপ্তির গুরুত্ব অপরিসীম।
এ প্রেক্ষাপটে নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়- এটা মুসলমানদের জয়-পরাজয় নয় বরং ‘অর্জন’। আর এই অর্জনের ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।
-----------------------------------------
বইঃ মুখতাসার যাদুল মা‘আদ , অধ্যায়ঃ অনুচ্ছেদ সমুহের সূচী ও বিবরন, অনুচ্ছেদঃ উহুদ যুদ্ধের শিক্ষা - প্রথম ভাগ
উহুদ যুদ্ধের শিক্ষা - প্রথম ভাগ
উহুদ যুদ্ধে যে সমস্ত শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আল-ইমরানের ১২১ নং আয়াত থেকে শুরু করে ১৬০ নং আয়াতের মধ্যে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে মুসলমানদেরকে রসূলের কথা অমান্য করা, মতভেদ করা এবং ছত্রভঙ্গ হওয়ার মন্দ পরিণাম সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া। যাতে তারা ভবিষ্যতে সতর্ক হয়ে যায় এবং যে সমস্ত বিষয় তাদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে তা থেকে বিরত থাকে।
নাবী-রসূল ও তাদের অনুসারীদের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ একটি হিকমত ও রীতি হচ্ছে তারা কখনও জয়লাভ করবে আবার কখনও পরাজিত হবে। তবে সর্বশেষে তাদেরই বিজয় হবে। সবসময় তাদেরকে বিজয় দান করলে সত্যিকার মুমিন ও অন্যদের মাঝে পার্থক্য করা সম্ভব হবেনা। আর সবসময় পরাজিত করলে নাবী-রসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য সফল হবেনা।
ﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻟِﻴَﺬَﺭَ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﺎ ﺃَﻧْﺘُﻢْ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺣَﺘَّﻰ ﻳَﻤِﻴﺰَ ﺍﻟْﺨَﺒِﻴﺚَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻄَّﻴِّﺐِ ﻭَﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻟِﻴُﻄْﻠِﻌَﻜُﻢْ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻐَﻴْﺐِ ﻭَﻟَﻜِﻦَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻳَﺠْﺘَﺒِﻲ ﻣِﻦْ ﺭُﺳُﻠِﻪِ ﻣَﻦْ ﻳَﺸَﺎﺀُ ﻓَﺂﻣِﻨُﻮﺍ ﺑِﺎﻟﻠﻪِ ﻭَﺭُﺳُﻠِﻪِ ﻭَﺇِﻥْ ﺗُﺆْﻣِﻨُﻮﺍ ﻭَﺗَﺘَّﻘُﻮﺍ ﻓَﻠَﻜُﻢْ ﺃَﺟْﺮٌ ﻋَﻈِﻴﻢٌ
‘‘তোমরা বর্তমানে যে অবস্থায় আছো, আল্লাহ মুমিনদের কখনও সেই অবস্থায় থাকতে দিবেন না। পাক-পবিত্র লোকদেরকে তিনি নাপাক ও অপবিত্রকে লোকদের থেকে আলাদা করেই ছাড়বেন। কিন্তু তোমাদেরকে গায়েবের খবর জানিয়ে দেয়া আল্লাহর রীতি নয়। কিন্তু আল্লাহ্ তাঁর রসূলদের মধ্যে হতে যাকে ইচ্ছা বাছাই করে নেন। সুতরাং আল্লাহর উপর এবং তাঁর রসূলগণের উপর তোমরা ঈমান আনয়ন কর। তোমরা যদি বিশ্বাসী হও এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তোমাদের জন্যে রয়েছে বিরাট প্রতিদান।’’[1] অর্থাৎ মুমিন ও মুনাফিকরা যেভাবে একসাথে মিশ্রিত অবস্থায় আছে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে সে অবস্থায় রেখে দিবেন না। বরং তিনি প্রকৃত মুমিনদেরকে মুনাফেকদের থেকে আলাদা করবেন। যেমন তিনি করেছিলেন উহুদ যুদ্ধের দিন। আল্লাহ্ তা‘আলা কাউকে গায়েবের খবর অবগত করেন না। কেননা গায়েবের মাধ্যমেই তিনি বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য করেন। আল্লাহ্ তা‘আলা চেয়েছেন যে, বাহ্যিকভাবেও যেন বিশ্বাসী ও মুনাফেকদের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। আর উহুদ যুদ্ধে তাই হয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তিনি তাঁর রসূলদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তাকে গায়েবের খবর অবগত করেন।
সুতরাং হে মুমিনগণ! তোমরা সেই গায়েবের প্রতি ঈমান আনয়নের মাধ্যমেই সৌভাগ্যবান হবে, যা তিনি তাঁর রসূলগণকে অবগত করেন। তোমরা যদি গায়েবের প্রতি ঈমান আনয়ন কর এবং তাকওয়ার পথ অবলম্বন কর, তাহলে তোমাদের জন্য রয়েছে বিরাট পুরস্কার।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের মধ্যে আরেকটি হিকমত এই ছিল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা দেখাতে চান যে, তাঁর খাঁটি বন্ধুরা সুখে-দুঃখে এবং পছন্দে-অপছন্দে তথা সকল অবস্থাতেই আল্লাহর ইবাদত করে। সুতরাং আল্লাহর প্রকৃত বান্দা তারাই, যারা উভয় অবস্থাতেই আল্লাহর ইবাদত করে। তারা ঐ সকল লোকদের মত নয়, যারা শুধু সুখে থাকা অবস্থাতেই আল্লাহর পথে থাকে।
আল্লাহ্ যদি সবসময় তাদেরকে বিজয়ী করতেন, তাহলে তাদের অবস্থা ঐ সব লোকদের মতই হতো, যাদেরকে রিযিকের ব্যাপারে প্রশস্ততা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় হিকমত ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সকল মাখলুকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। তিনি মাখলুকের সকল অবস্থা সম্পর্কে জানেন ও তা দেখেন।
বান্দারা যখন আল্লাহর দরবারেই নিজেদের অক্ষমতা ও অপারগতা তুলে ধরে দু’আ করে তখন তারা বিজয়ের হকদার হয়ে যায়। আর দুর্বলতা ও পরাজয়ের লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার পর বিজয়ের পোশাক খুব ভাল লাগে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﻧَﺼَﺮَﻛُﻢُ ﺍﻟﻠﻪُ ﺑِﺒَﺪْﺭٍ ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢْ ﺃَﺫِﻟَّﺔٌ ﻓَﺎﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠﻪَ ﻟَﻌَﻠَّﻜُﻢْ ﺗَﺸْﻜُﺮُﻭﻥَ
‘‘বস্ত্তত আল্লাহ্ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। কাজেই আল্লাহ্কে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার। (সূরা আল-ইমরান-০৩:১২৩)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-
ﻟَﻘَﺪْ ﻧَﺼَﺮَﻛُﻢُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻓِﻲ ﻣَﻮَﺍﻃِﻦَ ﻛَﺜِﻴﺮَﺓٍ ﻭَﻳَﻮْﻡَ ﺣُﻨَﻴْﻦٍ ﺇِﺫْ ﺃَﻋْﺠَﺒَﺘْﻜُﻢْ ﻛَﺜْﺮَﺗُﻜُﻢْ ﻓَﻠَﻢْ ﺗُﻐْﻦِ ﻋَﻨْﻜُﻢْ ﺷَﻴْﺌًﺎ ﻭَﺿَﺎﻗَﺖْ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢُ ﺍﻟْﺄَﺭْﺽُ ﺑِﻤَﺎ ﺭَﺣُﺒَﺖْ ﺛُﻢَّ ﻭَﻟَّﻴْﺘُﻢْ ﻣُﺪْﺑِﺮِﻳﻦَ ﺛُﻢَّ ﺃَﻧْﺰَﻝَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺳَﻜِﻴﻨَﺘَﻪُ ﻋَﻠَﻰ ﺭَﺳُﻮﻟِﻪِ ﻭَﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﻭَﺃَﻧْﺰَﻝَ ﺟُﻨُﻮﺩًﺍ ﻟَﻢْ ﺗَﺮَﻭْﻫَﺎ ﻭَﻋَﺬَّﺏَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻛَﻔَﺮُﻭﺍ ﻭَﺫَﻟِﻚَ ﺟَﺰَﺍﺀُ ﺍﻟْﻜَﺎﻓِﺮِﻳﻦَ
‘‘আল্লাহ্ তোমাদের সাহায্য করেছেন অনেক ক্ষেত্রে এবং হোনাইনের দিনে, যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদের প্রফুল্ল করেছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেবও তোমাদের জন্যে সংকুচিত হয়েছিল। অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। তারপর আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূল ও মুমিনদের উপর নাযিল করেন নিজের পক্ষ থেকে প্রশান্তি এবং অবতীর্ণ করেন এমন সেনাবাহিনী, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি। আর শাস্তি প্রদান করেন কাফেরদের এবং এই হল কাফেরদের কর্মফল’’।[2]
আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় বানদাদের জন্য বেহেশতের মধ্যে এমন কিছু মর্যাদা নির্ধারণ করেছেন, যা শুধু আমলের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। বালা-মসিবতে আক্রান্ত হওয়া ব্যতীত তা পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব নয়। সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের জন্য বালা-মসিবত দ্বারা পরীক্ষা করার পর উক্ত মনজিলে পৌঁছায়ে দেন। সেই সাথে তিনি সৎ আমল করারও তাওফীক দান করেন।
সর্বদা সুস্থ থাকা, সবসময় বিজয় অর্জন হতে থাকা এবং প্রচুর নিয়ামাত ও কল্যাণের মধ্যে থাকা মুমিনদেরকে দুনিয়ার মায়া-মমতায় ফেলে দেয় এবং তাদের হৃদয়ের মধ্যে মরিচা পড়ে যায় এবং আল্লাহর পথে এবং আখিরাতের সুন্দর জীবনের দিকে চলতে হৃদয়কে বাধাগ্রস্ত করে।
আর আল্লাহ্ যখন তাঁর কোন বান্দাকে সম্মানিত করতে চান তখন তাকে বালা-মসিবতে ফেলে আখিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনেন। এটিই হচ্ছে তার চিকিৎসা।
উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে আল্লাহর নিকট শাহাদাত হচ্ছে সর্বোচ্চ মর্যাদা। তাই তিনি স্বীয় বন্ধুদের মধ্য হতে কতিপয়কে শহীদ হিসাবে বেছে নিতে চান।
আল্লাহ্ তা‘আলা যখন তার দুশমনদেরকে হালাক (ধ্বংস) করতে চান তখন তাদেরকে দিয়ে এমন কিছু করিয়ে নেন, যাতে তারা ধ্বংসের হকদার হয়ে যায়। এ সবের মধ্যে রয়েছে, কুফরীতে বাড়াবাড়ি করা, সীমা লংঘন করা, আল্লাহর অলীদেরকে মাত্রাতিরিক্ত কষ্ট দেয়া, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইত্যাদি। এর মাধ্যমে আল্লাহর বান্দাগণ গুনাহ থেকে পবিত্র হয়ে যায় এবং দুশমনরা ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻟَﺎ ﺗَﻬِﻨُﻮﺍ ﻭَﻟَﺎ ﺗَﺤْﺰَﻧُﻮﺍ ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢُ ﺍﻟْﺄَﻋْﻠَﻮْﻥَ ﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﻣُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﺇِﻥْ ﻳَﻤْﺴَﺴْﻜُﻢْ ﻗَﺮْﺡٌ ﻓَﻘَﺪْ ﻣَﺲَّ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡَ ﻗَﺮْﺡٌ ﻣِﺜْﻠُﻪُ ﻭَﺗِﻠْﻚَ ﺍﻟْﺄَﻳَّﺎﻡُ ﻧُﺪَﺍﻭِﻟُﻬَﺎ ﺑَﻴْﻦَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ ﻭَﻟِﻴَﻌْﻠَﻢَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﻭَﻳَﺘَّﺨِﺬَ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﺷُﻬَﺪَﺍﺀَ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﻟَﺎ ﻳُﺤِﺐُّ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤِﻴﻦَ ﻭَﻟِﻴُﻤَﺤِّﺺَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁَﻣَﻨُﻮﺍ ﻭَﻳَﻤْﺤَﻖَ ﺍﻟْﻜَﺎﻓِﺮِﻳﻦَ
‘‘আর তোমরা নিরাশ হয়োনা এবং দুঃখ করোনা। যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে। তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ্ জানতে চান, কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ্ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না। আর এ কারণে আল্লাহ্ ঈমানদারদেরকে পাক-সাফ করতে চান এবং কাফেরদেরকে ধ্বংস করে দিতে চান।’’ (সূরা আল-ইমরান-৩:১৩৯-১৪১) এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তা‘আলা একই সাথে মুমিনদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন এবং উহুদের যুদ্ধে তাদের যে ক্ষতি হয়েছিল তার জন্য উত্তমভাবে শান্তনা দিয়েছেন। সেই সাথে যে কারণে উহুদ যুদ্ধে তাদের উপর কাফেরদেরকে বিজয়ী করেছেন তাও বলে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﺇِﻥْ ﻳَﻤْﺴَﺴْﻜُﻢْ ﻗَﺮْﺡٌ ﻓَﻘَﺪْ ﻣَﺲَّ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡَ ﻗَﺮْﺡٌ ﻣِﺜْﻠُﻪُ ﻭَﺗِﻠْﻚَ ﺍﻟْﺄَﻳَّﺎﻡُ ﻧُﺪَﺍﻭِﻟُﻬَﺎ ﺑَﻴْﻦَ ﺍﻟﻨَّﺎﺱِ
‘‘তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি’’। (সূরা আল-ইমরান-৩:১৪০) সুতরাং তোমাদের কি হল যে, তোমরা নিরাশ হচ্ছ এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছ। ইতিপূর্বে কাফেররাও আহত হয়েছে। আর তাদের সেই আঘাত ছিল শয়তানের পথে। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি দুনিয়ার দিনসমূহ মানুষের মাঝে ঘুরিয়ে থাকেন। কেননা এটি এমন বিষয়, যা দুনিয়াতে তিনি তাঁর বন্ধু ও শত্রু উভয় শ্রেণীর লোকদের মধ্যেই ভাগ করে থাকেন। তবে আখিরাতের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে কেবল আল্লাহর বন্ধুগণই নেয়ামত ভোগ করবে। আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হিকমত উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে খাঁটি মুমিনদেরকে মুনাফেকদের থেকে আলাদা করা। ইতিপূর্বে মুনাফেকদেরকে মুমিনগণ চিনতেন না। তারা কেবল আল্লাহর ইলমেই ছিল। এবার মুমিনগণ মুনাফেকদেরকে কপালের চোখ দিয়ে দেখে নিলেন এবং গায়েবী বিষয়টি জেনে ফেললেন।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের আরেকটি হিকমতের কথা উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের থেকে কাউকে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করা।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﻟَﺎ ﻳُﺤِﺐُّ ﺍﻟﻈَّﺎﻟِﻤِﻴﻦَ
‘‘আর আল্লাহ্ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না’’। এখানে সুক্ষ্ণ ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুনাফেকরা যেহেতু উহুদ যুদ্ধের দিন আল্লাহর নাবীকে ফেলে চলে এসেছিল, তাই তিনি তাদেরকে পছন্দ করেন নি এবং তাদের থেকে কাউকে শহীদ হিসাবেও গ্রহণ করেন নি। উহুদ যুদ্ধে মুমিনদের পরাজয়ের আরেকটি হিকমত হচ্ছে, তাদেরকে গুনাহ্ থেকে পবিত্র করা এবং মুনাফেকদের থেকে আলাদা করা। উহুদ যুদ্ধের পর থেকে মুমিনগণ মুনাফেকদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।
এতে আরও হিকমত রয়েছে যে, প্রথমে কাফেরদেরকে সীমালংঘনের সুযোগ দেয়া এবং সেই কারণে তাদেরকে ধ্বংস করা। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ সমস্ত মুমিনদের ধারণা খন্ডন করেছেন, যারা মনে করত যে, বিনা জিহাদেই জান্নাতে যাওয়া যাবে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﺃَﻡْ ﺣَﺴِﺒْﺘُﻢْ ﺃَﻥْ ﺗَﺪْﺧُﻠُﻮﺍ ﺍﻟْﺠَﻨَّﺔَ ﻭَﻟَﻤَّﺎ ﻳَﻌْﻠَﻢِ ﺍﻟﻠﻪُ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺟَﺎﻫَﺪُﻭﺍ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﻭَﻳَﻌْﻠَﻢَ ﺍﻟﺼَّﺎﺑِﺮِﻳﻦَ
‘‘তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ্ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্যশীল?’’ (সূরা আল-ইমরান-৩: ১৪২) অর্থাৎ তোমাদের থেকে এখন পর্যন্ত উহা লক্ষ্য করা যায়নি। যাতে করে তার পুরুস্কার দেয়া যায়। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা মুমিনদেরকে এই বলে ধমক দিয়েছেন যে, তোমরা যেহেতু জিহাদের কামনা করেছিলে এবং শত্রুদের সাথে মুকাবেলা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলে, তাই এখন পলায়ন করলে কেন? আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﺗَﻤَﻨَّﻮْﻥَ ﺍﻟْﻤَﻮْﺕَ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻞِ ﺃَﻥْ ﺗَﻠْﻘَﻮْﻩُ ﻓَﻘَﺪْ ﺭَﺃَﻳْﺘُﻤُﻮﻩُ ﻭَﺃَﻧْﺘُﻢْ ﺗَﻨْﻈُﺮُﻭﻥَ
‘‘আর তোমরা তো মৃত্যু আসার আগেই মরণ কামনা করতে, কাজেই এখন তো তোমরা তা চোখের সামনে উপস্থিত দেখতে পাচ্ছ’’। (সূরা আল-ইমরান-৩: ১৪৩) আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন- আল্লাহ্ তা‘আলা যখন তাঁর নাবীর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বদরের যুদ্ধের শহীদদের মর্যাদা সম্পর্কে অবগত করলেন তখন ঐ সমস্ত মুসলমান নতুন কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে শাহাদাতের তামান্না (আকাঙ্খা) প্রকাশ করলেন, যারা বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের জন্য উহুদ যুদ্ধে বের হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। সেখানে গিয়ে কতিপয় লোক ব্যতীত যখন তারা পলায়ন করল তখন আল্লাহ্ তা‘আলা উপরোক্ত আয়াত নাযিল করেন।
উহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের আরেকটি কারণ ছিল এই যে, নাবী (সাঃ) জীবিত থাকতেই এমন একটি ভূমিকা পেশ করা যাতে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত থাকবে যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) অচিরেই মৃত্যু বরণ করবেন। নিয়ামতের প্রকৃত শোকর আদায়কারী তারাই হতে পারবে, যারা তাদের মাঝে রসূল (সাঃ) জীবিত থাকার নিয়ামতের কদর বুঝতে সক্ষম হবে তাঁর সাথে দৃঢ় থাকবে এবং পশ্চাৎমুখী হবেনা। যারা এ রকম হবার তাওফীক প্রাপ্ত হবে তারাই পুরস্কৃত হবে। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন যে, প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করবে। মুহাম্মাদ (সাঃ)ও মৃত্যু বরণ করবেন। কারণ তাঁর পূর্বেও অনেক নাবী-রসূল মৃত্যু বরণ করেছেন। তাদের সাথেও অনেক অনুসারী নিহত হয়েছেন। আর যারা বেঁচে ছিলেন, তারা দূর্বল হয়ে যান নি কিংবা যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিরাশ হয়ে যান নি। তারা শক্ত মনোবল ও সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি নিয়ে যুদ্ধ করে শাহাদাত অর্জনের স্পৃহা নিয়ে বেঁচে ছিলেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) অনন্তকাল বেঁচে থাকার জন্য প্রেরিত হন নি। সুতরাং তিনি মারা গেলে বা নিহত হলে মুসলমানদের পিছপা হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাদেরকে তাঁর রেখে যাওয়া দ্বীন ও তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে এবং মৃত্যু বা নিহত হওয়া পর্যন্ত এর উপরই অবিচল থাকতে হবে।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ সমস্ত বিষয়ের আলোচনা করেছেন, যার মাধ্যমে নাবী-রসূল ও তাদের অনুসারীগণ তাদের জাতির উপর জয়লাভ করেছিলেন। আর তা হচ্ছে নিজেদের ভুল-ত্রুটি স্বীকার করা, তাওবা করা, সত্যের উপর অটুট রাখার জন্য তাদের প্রভুর কাছে প্রার্থনা করা এবং শত্রুর উপর জয়লাভ করার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﻗَﻮْﻟَﻬُﻢْ ﺇِﻟَّﺎ ﺃَﻥْ ﻗَﺎﻟُﻮﺍ ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﺍﻏْﻔِﺮْ ﻟَﻨَﺎ ﺫُﻧُﻮﺑَﻨَﺎ ﻭَﺇِﺳْﺮَﺍﻓَﻨَﺎ ﻓِﻲ ﺃَﻣْﺮِﻧَﺎ ﻭَﺛَﺒِّﺖْ ﺃَﻗْﺪَﺍﻣَﻨَﺎ ﻭَﺍﻧْﺼُﺮْﻧَﺎ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡِ ﺍﻟْﻜَﺎﻓِﺮِﻳﻦَ ﻓَﺂَﺗَﺎﻫُﻢُ ﺍﻟﻠﻪُ ﺛَﻮَﺍﺏَ ﺍﻟﺪُّﻧْﻴَﺎ ﻭَﺣُﺴْﻦَ ﺛَﻮَﺍﺏِ ﺍﻟْﺂَﺧِﺮَﺓِ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﻳُﺤِﺐُّ ﺍﻟْﻤُﺤْﺴِﻨِﻴﻦَ
‘‘তারা আর কিছুই বলেনি, শুধু বলেছে, হে আমাদের প্রতিপালক! মোচন করে দাও আমাদের পাপ এবং যা কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমাদের কাজে। আর আমাদেরকে দৃঢ় রাখ এবং কাফেরদের উপর আমাদেরকে সাহায্য কর। অতঃপর আল্লাহ্ তাদেরকে দুনিয়ার সওয়াব দান করেছেন এবং যথার্থ আখিরাতের সওয়াব। আর যারা সৎকর্মশীল আল্লাহ্ তাদেরকে ভালবাসেন’’। (সূরা আল-ইমরান-৩: ১৪৭-১৪৮) সুতরাং তারা আল্লাহর কাছে তাদের গুনাহ্ থেকে ক্ষমা চেয়েছেন, যুদ্ধের সময় তাদের পদসমূহকে দৃঢ় রাখার দু’আ করেছেন এবং আল্লাহর সাহায্য চেয়েছেন। কেননা তারা জেনেছিল যে, মুসলমানদের গুনাহের কারণেই তাদের উপর দুশমনরা জয়লাভ করে থাকে এবং শয়তান তাদের গোমরাহ করে ও এর মাধ্যমেই তাদেরকে পরাজিত করে। গুনাহ্সমূহ দুই প্রকার। (১) হকসমূহ আদায়ের ক্ষেত্রে ত্রুটি করা এবং (২) কিছু গুনাহ হয়ে থাকে সীমালংঘনের কারণে। আর আনুগত্য করার মাধ্যমেই মুসলমানদের জন্য আল্লাহর সাহায্য এসে থাকে। তারা বলেছিলেন- হে আমাদের প্রতিপালক! মোচন করে দাও আমাদের পাপ এবং যা কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমাদের কাজে। আর আমাদেরকে দৃঢ় রাখ এবং কাফেরদের উপর আমাদেরকে সাহায্য কর। তারা জেনেছিল যে, আল্লাহ্ যদি তাদেরকে দৃঢ়পদ না রাখেন এবং সাহায্য না করেন, তাহলে কখনই তারা জয়লাভ করতে পারবেন না। তারা আল্লাহর কাছে ঐ বিষয় চেয়েছিলেন, যা আল্লাহর হাতে রয়েছে। তারা উভয় দিকের প্রতিই খেয়াল রেখেছিলেন। তাওহীদের বাস্তবায়ন এবং উহার হকসমূহ পরিপূর্ণরূপে আদায় করে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। সেই সাথে বিজয় আসার পথে যে সমস্ত বাধা থাকতে পারে তা দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর তা হচ্ছে পাপাচারিতা ও জুলুম। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা মুনাফেক ও মুশরিক শত্রুদের তাবেদারী করতে নিষেধ করেছেন। তারা যদি শত্রুদের আনুগত্য করে তাহলে তারা উভয় জগতেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে ঐ সমস্ত মুনাফেকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের পর কাফেরদের পূর্ণ তাবেদারী করা শুরু করে দিয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- তিনিই মুমিনদের অভিভাবক এবং সর্বোত্তম সাহায্যকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি মুহাববাত রাখবে সেই বিজয়ী হবে। তিনি শত্রুদের অন্তরে ভয় ঢেলে দিবেন। যেই ভয় তাদেরকে মুসলমানদের উপর হামলা করতে বাধা দিবে। শিরক ও কুফরীর কারণেই এমন ভীতি তাদের অন্তরে প্রবেশ করবে। যেই মুমিন ঈমানের সাথে শিরক মিশ্রিত করে নি, তার জন্যই রয়েছে হিদায়াত ও নিরাপত্তা।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি মুমিনদেরকে সাহায্য করার সত্য ওয়াদা করেছেন এবং বলেছেন যে, তারা যদি বরাবরই আনুগত্য করতে থাকে, তাহলে তারা সদা বিজয় অর্জন করতে থাকবে। তবে সমস্যা হচ্ছে মুসলিমরা আনুগত্যের পথ ছেড়ে দেয়ার কারণে বিজয় ও সাহায্য তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সুতরাং গুনাহ ও পাপ কাজের মন্দ পরিণাম সম্পর্কে জানিয়ে দেয়ার জন্য ও ভাল কাজের শুভ পরিণাম সম্পর্কে অবগত করে দেয়ার জন্য এবং পরীক্ষা করার জন্য তাদের থেকে বিজয়কে সরিয়ে নিয়েছেন।
এত কিছুর পরও তিনি মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হাসান বসরী (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল- শত্রুকে মুসলমানদের উপর শক্তিশালী করে দেয়ার পর ক্ষমা করে দেয়া হল কিভাবে? উত্তরে তিনি বললেন- আল্লাহর ক্ষমা না হলে শত্রুরা তাদের মূলোৎপাটন করে ফেলত। তারা মুসলমানদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সুতরাং তাঁর ক্ষমার কারণেই এইবার তিনি শত্রুদেরকে প্রতিহত করেছেন।
এরপর আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধের দিন মুসলমানদের ঐ দৃশ্য ও অবস্থার আলোচনা করেছেন, যখন তারা পাহাড়ের উপর আরোহন করে পলায়ন করছিল। তারা আল্লাহর রসূল ও সাহাবীদের প্রতি ফিরেও তাকাচ্ছিলেন না। অথচ রসূল (সাঃ) পিছন দিক থেকে এই বলে ডাকছিলেন যে, হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা আমার দিকে ফিরে এসো। আমি আল্লাহর রসূল! সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের এই পলায়নের কারণে দুশ্চিন্তার পর দুশ্চিন্তায় ফেলার মাধ্যমে পরীক্ষা করেছেন। (এক) পলায়নের কারণে নেমে আসা বিষিণ্ণতা। (দুই) শয়তানের এই বলে চিৎকারের বিষণ্ণতা যে, সে বলেছিল মুহাম্মাদ (সাঃ) নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন- পলায়নের মাধ্যমে যেহেতু তারা রসূল (সাঃ) কে পেরেশানীর মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, তাই আল্লাহ্ তা‘আলাও তাদেরকে দুশ্চিন্তায় ফেলে পরীক্ষায় ফেলেছেন। তবে নিম্নলিখিত কারণে প্রথম কথাটিই অধিক সুস্পষ্ট: ১. আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻟِﻜَﻴْﻠَﺎ ﺗَﺤْﺰَﻧُﻮﺍ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﺎ ﻓَﺎﺗَﻜُﻢْ ﻭَﻟَﺎ ﻣَﺎ ﺃَﺻَﺎﺑَﻜُﻢْ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﺧَﺒِﻴﺮٌ ﺑِﻤَﺎ ﺗَﻌْﻤَﻠُﻮﻥَ
‘‘যাতে তোমরা হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া বস্ত্তর জন্য দুঃখ না কর এবং যার সম্মুখীন হচ্ছ সে জন্য বিষণ্ণ না হও। আর আল্লাহ্ তোমাদের কাজের ব্যাপারে অবহিত রয়েছেন’’।[3] এখানে মুসলমানদেরকে বিষণ্ণগ্রস্ত করার পর পুনরায় বিষণ্ণ করা হিকমত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যাতে তারা বিজয় হাত ছাড়া হওয়ার কারণে এবং পরাজিত হওয়ার কারণে আপতিত দুশ্চিন্তা ভুলে যায়। আর এটি ঐ রকম একটি পেরেশানী ঢেলে দেয়ার মাধ্যমেই সম্ভব, যার পরে আরেকটি পেরেশানী আগমন করেছিল।
২. প্রথম ব্যাখ্যাটিই বাস্তব সম্মত। তারা একাধিক পেরেশানীতে পড়েছিল। সেদিন গণীমতের মাল অর্জন না করতে পারার বিষণ্ণতা, পরাজিত হওয়ার বিষণ্ণতা, আহত ও নিহত হওয়ার বিষণ্ণতা, নাবী (সাঃ) নিহত হওয়ার গুজব এবং শত্রুদের পাহাড়ের উপর উঠে পড়া। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এখানে শুধু দু’টি পেরেশানী ছিলনা; বরং পেরেশানীর পর পেরেশানী আসতেই ছিল। যাতে করে তাদের ঈমানের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা হয়ে যায়।
৩. এখানে গাম্ম (পেরেশানী) দ্বারা সাজা ও শাস্তিকে পরিপূর্ণ করা হয়েছে। সাজা অর্জনের কারণ হিসাবে নির্ধারণ করা হয়নি। সার কথা হচ্ছে নাবী (সাঃ) কে বর্জন করা, যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করা, রসূলের ডাকে সাড়া না দেয়া, তাঁর কথা অমান্য করে তীরন্দাজদের স্থান ত্যাগ করা, পরস্পর মতবিরোধ করা এবং মনোবল হারা হয়ে যাওয়া- এগুলো এমন বিষয় যার প্রত্যেকটিই একটি করে পেরেশানী ডেকে আনে। সুতরাং পেরেশানীতে পড়ার একাধিক কারণ পাওয়া গিয়েছিল বলেই একের পর এক পেরেশানী এসেছিল। মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর অপার অনুগ্রহ ও দয়ার কারণেই তাদের থেকে এমন কিছু স্বভাবগত মন্দ আচরণ প্রকাশ হয়েছিল, যা স্থায়ী বিজয়ের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই এগুলো থেকে তাদেরকে পরিষ্কার করার জন্য এমন কিছু কারণ তৈরী করেছেন, যার ফলাফল বাহ্যিক দৃষ্টিতে খারাপ মনে হচ্ছিল। তখন তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, কৃত অপরাধ থেকে তাওবা করা, উপরোক্ত অপরাধগুলো জরুরী ভিত্তিতে পরিহার করা। আর পাপ কাজ ছেড়ে দিয়ে তার স্থলে নেক কাজ করা অত্যন্ত জরুরী। এ ছাড়া স্থায়ী সাহায্য ও বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়। সুতরাং উহুদ যুদ্ধের পর তারা সতর্ক হয়ে গেল এবং যেই দরজা দিয়ে পরাজয়ের কারণগুলো প্রবেশ করেছিল, তা সম্পর্কে অবগত হয়ে গেল। কেননা কখনও অসুস্থতার মাধ্যমেও শরীর সুস্থ হয়ে থাকে। অর্থাৎ পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার পর বান্দা যখন তাওবা করে তখন সে গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়। তার শরীর ও মন পূর্বের তুলনায় অধিক সুস্থতা অনুভব করে।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলিমদের উপর দয়া ও রহমত বশতঃ তাদের উপর নিদ্রা ঢেলে দিয়ে পেরেশানীকে দূর করে দিয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে নিদ্রা হচ্ছে বিজয়ের আলামত। বদরের যুদ্ধেও আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে তন্দ্রা ও নিদ্রা দিয়ে আচ্ছাদিত করেছিল। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- যার উপর নিদ্রা আগমণ করেনি, সে ঐ সমস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত যারা নিজেদের নফস্ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তার কাছে দ্বীন, নাবী বা সঙ্গী-সাথীর কোন মূল্য ছিলনা। আর তারা আল্লাহ্ সম্পর্কে জাহেলী যামানার লোকদের ধারণা পোষণ করেছিল।
আল্লাহর রসূল সম্পর্কে তাদের ধারণা কেমন ছিল- এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, তারা ধারণা করত যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে সাহায্য করবেন না। অচিরেই মুহাম্মাদের কর্ম-কান্ড ও প্রচেষ্টার অবসান ঘটবে। তারা আরও ধারণা করেছিল যে, তাদের যে বিপর্যয় হয়েছিল, তা আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর অনুযায়ী হয়নি। এতে আল্লাহর বিশেষ কোন হিকমতও ছিলনা। সুতরাং তারা কাদ্র (তাকদীর), হিকমতে ইলাহী এবং দ্বীনে ইলাহীর বিজয় হওয়ার কথা অস্বীকার করেছিল। এটিই ছিল তাদের মন্দ ধারণা। যেই ধারণা করেছিল মক্কার মুশরিক এবং মদ্বীনার মুনাফেকরা। সূরা ফাতাহ্-এর মধ্যে এ সবের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এই ধারণা ছিল একটি মন্দ ধারণা। কারণ এটি এমন একটি ধারণা, যা আল্লাহর যাতে পাক, তাঁর সুমহান নাম, গুণাবলী, তাঁর হিকমতের ক্ষেত্রে মোটেই ঠিক নয়। তেমনি এমন ধারণা আল্লাহর একচছত্র রুবুবীয়াত ও উলুহীয়াতের শানেও প্রযোজ্য নয়। কারণ আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং যে ধারণা করবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রিসালাতকে পূর্ণতা দান করবেন না, সত্যের উপর বাতিলকে সবসময় বিজয়ী রাখবেন, সত্য বাতিলের সামনে দুর্বল হয়ে থাকবে এবং এরপর সত্য কখনই মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবেনা, সে অবশ্যই আল্লাহর ব্যাপারে মন্দ ধারণা করল। সে আল্লাহর সাথে এমন বিষয়কে সম্পৃক্ত করল, যা আল্লাহর সিফাতে কামালিয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যে ব্যক্তি ঐ প্রকারের কোন কর্মে তাকদীরে ইলাহীকে অস্বীকার করল সে আল্লাহর ক্ষমতা ও রাজত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আর যে সমস্ত লোক আল্লাহর সেই হিকমতকে অস্বীকার করল, যার কারণে তিনি প্রশংসার হকদার এবং এই ধারণা পোষণ করল যে, উহুদের যুদ্ধে আল্লাহ্ মুমিনদেরকে পরাজিত করতে চেয়েছেন বলেই তা করেছেন, এর পিছনে অন্য কোন হিকমত নিহিত নেই, তারা কাফেরদের ন্যায়ই ধারণা করল। আর কাফেরদের জন্যই রয়েছে ধ্বংস ও জাহান্নাম।
অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ্ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে থাকে। বিশেষ করে ঐ সমস্ত বিষয়ে, যা তাদের তাকদীরের সাথে সম্পৃক্ত। যারা আল্লাহর যাতে পাক, তাঁর পবিত্র নামসমূহ, তাঁর ত্রুটিমূক্ত সিফাতসমূহ এবং হিকমতসমূহ ও তিনিই যে যথাযথ প্রশংসার হকদার এ সম্পর্কে যারা অবগত, তারাই কেবল আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারনা করা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। যে মুমিন আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হল, সে আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল। যে ব্যক্তি এই বিশ্বাস পোষণ করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সৎ বান্দাদেরকে শাস্তি দিবেন এবং তাঁর বন্ধু ও শত্রুদের সাথে একই আচরণ করবেন, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল।
যে ব্যক্তি মনে করল যে, আল্লাহর বান্দারা তাঁর আদেশ-নিষেধের আওতাভুক্ত নয়, সেও আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি অসৎ ধারণা করল। এমনি কল্পনা করল যে, তিনি ভাল কাজের বিনিময়ে ছাওয়াব ও খারাপ কাজের বিনিময়ে শাস্তি দিবেন না এবং যে বিষয়ে মানুষেরা মতভেদ করছে, তাতে তিনি কিয়ামতের দিন ফয়সালা প্রদান করবেন না সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যারা বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা বিনা কারণেই বান্দার সৎকাজকে নষ্ট করে দিবেন এবং যেই কর্মে বান্দার কোন দোষ নেই, তার জন্যও তিনি বান্দাকে শাস্তি দিবেন অথবা আল্লাহ্ তা‘আলা সেই সমস্ত মুজেযা দ্বারা তাঁর শত্রুদেরকে শক্তিশালী করবেন, যেগুলো দ্বারা তিনি তাঁর রসূলদেরকে শক্তিশালী করেছেন এবং যে মনে করবে যে, আল্লাহ্ থেকে যা আসবে তার সবই একই রকম ভাল, এমন কি যে ব্যক্তি সারা জীবন আল্লাহর আনুগত্যে কাটিয়েছে, তাকে চিরকালের জন্য জাহান্নামে পাঠানো এবং যে ব্যক্তি সারা জীবন আল্লাহর নাফরমানীতে শেষ করেছে, তাকে জান্নাতে পাঠানোও আল্লাহর জন্য একই রকম উত্তম এবং উভয়টি একই রকম সুন্দর, যে ব্যক্তি ধারণা করল, ভাল-মন্দ- এ দু’টির মাঝে অহীর মাধ্যম ছাড়া পার্থক্য করা সম্ভব নয়, কারণ মানুষের বিবেক কোনটিকে মন্দ ও কোনটিকে সুন্দর সাব্যস্ত করতে সক্ষম নয়, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যে ব্যক্তি বিশ্বাস করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের সত্ত্বা, গুণাবলী এবং তাঁর কর্মসমূহ সম্পর্কে যেই সংবাদ দিয়েছেন, তার প্রকাশ্য অর্থ বাতিল এবং তা উপমা স্বরূপ। এখানে মূল সত্যকে সুস্পষ্ট করে উল্লেখ না করে ছেড়ে দিয়ে দূর থেকে তার দিকে ইশারা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি মনে করবে যে, কুরআন মজীদে সর্বদা অর্থহীন শব্দ ও উপমা পেশ করা হয়েছে, সেও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করল। যারা মনে করল, আল্লাহ্ চেয়েছেন যে, তাঁর বান্দারা স্বীয় কালামের অর্থ পরিবর্তন করুক এবং সেই অর্থ দ্বারা তাদের মসিত্মস্ককে পরিপূর্ণ করুক এবং তাঁর নাম ও গুণাবলীর পরিচয় জানার জন্য তিনি তাদেরকে বিবেকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন; তাঁর কিতাবের উপর নির্ভর করতে বলেন নি, তারাও আল্লাহর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করল। যারা মনে করে, আল্লাহ্ তাদেরকে স্বীয় কালামের সেই বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতে বলেন নি, যার প্রতি আরবী ভাষা সুস্পষ্ট নিদের্শনা প্রদান করে (অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা খোলাখুলিভাবে হক প্রকাশ করতে সম্পূর্ণ সক্ষম এবং ঐ সমস্ত শব্দ দূর করতে সক্ষম, যেগুলো মানুষকে বাতিল আকীদার দিকে নিয়ে যায়) তারাও আল্লাহর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করল।
যে ব্যক্তি বিশ্বাস করল যে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রসূল ব্যতীত সে এবং তার উস্তাদরাই সত্য বলেছেন এবং তাদের কথাতেই রয়েছে সুস্পষ্ট হিদায়াত ও আল্লাহর কালামের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণের মধ্যে গোমরাহী ছাড়া অন্য কিছু নেই, তাদের ধারণা আল্লাহর প্রতি খুবই মন্দ। এদের সকলেই আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণকারী এবং আল্লাহর ব্যাপারে অন্যায় ও জাহেলিয়াতের ন্যায় ধারণা পোষণকারী।
এমনি যে ধারণা করল যে, আল্লাহর রাজ্যে আল্লাহর ইচ্ছার বাইরেও অন্য কিছু সংঘটিত হয়ে থাকে এবং এমন কিছু হয়ে থাকে, যা তিনি সৃষ্টি করতে ও গঠন করতে সক্ষম নন সেও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল। যারা বিশ্বাস করল আল্লাহ্ তা‘আলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কর্মহীন ছিলেন, কোন কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষমও ছিলেন না, অতঃপর তিনি কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হয়েছেন, সেও আল্লাহর প্রতি খুব খারাপ বিশ্বাস পোষণ করল। যারা বিশ্বাস করল, আল্লাহ্ শুনেন না, দেখেনও না এবং সৃষ্টি সম্পর্কে অবগতও নন সেও আল্লাহর প্রতি খুব খারাপ ধারণা পোষণ করল। আর যারা মনে করে আল্লাহর কোন ইচ্ছা নেই, কথা বলাও তাঁর গুণের অন্তর্ভুক্ত নয়, তিনি কারও সাথে কথা বলেন নি, বলবেনও না, কোন আদেশ বা নিষেধও করেন নি, তারাও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যারা ধারণা করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা আসমানসমূহের উপর আরশে সমুন্নত নন, সকল স্থানই তাঁর জন্য সমান এবং যারা সুবহানা রাববীয়াল আ-লা আর সুবহানা রাববীয়াল আসফাল বলাকে একই রকম মনে করে তাদের আকীদাহ্ খুবই খারাপ। যারা মনে করে আল্লাহ্ তা‘আলা কুফরী পাপাচারিতা এবং অবাধ্যতাকে আনুগত্যের ন্যায়ই ভালবাসেন ও পছন্দ করেন তারাও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল।
এমনি যারা বিশ্বাস করল যে, আল্লাহ্ কাউকে ভালবাসেন না, কারও প্রতি সন্তুষ্টও হন না, ক্রোধান্বিতও হন না, কাউকে বন্ধু হিসাবেও গ্রহণ করেন না, কাউকে দুশমন হিসাবেও গ্রহণ করেন না, তিনি কারও নিকটবর্তী হন না এবং অন্য কেউ তাঁর নিকটবর্তী হয়না, তারাও আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণকারী।
এমনিভাবে যে ব্যক্তি মনে করল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা পরস্পর বিরোধী দু’টি বিষয়কে একইভাবে মূল্যায়ন করেন এবং সকল দিক থেকে সমান দু’টি বস্ত্তর মধ্যে পার্থক্য করেন (অর্থাৎ ন্যায় বিচার বর্জন করেন) কিংবা একটি মাত্র কবীরা গুনাহ্এর কারণে সারা জীবনের সৎ আমল বরবাদ করে দেন এবং জাহান্নামে চিরস্থায়ী করেন, সেও আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করল।
সার কথা হচ্ছে, আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের জন্য যেই গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন অথবা আল্লাহর রসূল (সাঃ) আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র সত্তার জন্য যে সমস্ত গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন, কেউ যদি তার খেলাফ ধারণা পোষণ করে অথবা আল্লাহর গুণাবলীকে বাতিল বলে বিশ্বাস করে সেও আল্লাহর প্রতি খুব মন্দ ধারণা পোষণ করল।
চলমান.........
[1]. সূরা আল-ইমরান-০৩:১৭৯ [2]. সূরা তাওবা-৯:২৫-২৬ [3]. সূরা আল-ইমরান-৩: ১৫৩ http://www.hadithbd.com/shareqa.php?qa=3934
------------------------------------------------------
বইঃ মুখতাসার যাদুল মা‘আদ , অধ্যায়ঃ অনুচ্ছেদ সমুহের সূচী ও বিবরন, অনুচ্ছেদঃ উহুদ যুদ্ধের শিক্ষা - দ্বিতীয় ভাগ
উহুদ যুদ্ধের শিক্ষা - দ্বিতীয় ভাগ
এমনিভাবে যারা বিশ্বাস করল যে, আল্লাহর সন্তান রয়েছে অথবা তাঁর কোন শরীক আছে অথবা আল্লাহর অনুমতি ব্যতীতই তাঁর কাছে কেউ সুপারিশ করতে পারবে অথবা আল্লাহর মাঝে এবং তাঁর মাঝে কোন মাধ্যম (মধ্যস্থতাকারী রয়েছে), যারা আল্লাহর কাছে মাখলুকের প্রয়োজন পেশ করে থাকে অথবা যে ধারণা করল যে, আল্লাহর কাছে যা আছে, তা আনুগত্যের মাধ্যমেও পাওয়া যাবে এবং নাফরমানীর মাধ্যমেও পাওয়া যাবে অথবা ধারণা করল যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন কাজ ছেড়ে দিলে আল্লাহ্ তা‘আলা তার বদলে অন্য কিছু দিবেন না অথবা ধারণা করল যে, পাপ কাজের ইচ্ছা করলেই বিনা কারণে বান্দাকে শাস্তি দিবেন অথবা যে ব্যক্তি ধারণা করল যে, অন্তরে ভয় ও আশা নিয়ে নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করলেও আল্লাহ্ তাকে নিরাশ করবেন অথবা ধারণা করল যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) এর শত্রুরা তাঁর জীবদ্দশায় কিংবা মৃত্যুর পর সর্বদা বিজয়ী থাকবে, তারাও আল্লাহর প্রতি খুব মন্দ ধারণা পোষণ করল।
যারা ধারণা করল যে, রসূল (সাঃ) মৃত্যু বরণ করার পর লোকেরা আহলে বাইতের উপর জুলুম করেছে এবং তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে, আল্লাহর দুশমন এবং আহলে বাইতের দুশমনদের বিজয় হয়েছে, অথচ আল্লাহ্ আহলে বাইতকে সাহায্য করার ক্ষমতাবান হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাদেরকে সাহায্য করেন নি এবং যারা ধারণা করে যে, যারা রসূল (সাঃ) এর অসীয়তকে পরিবর্তন করেছে, তাদেরকেই (আবু বকর ও উমার (রাঃ) ) তাঁর পাশে কবর দেয়া হয়েছে আর উম্মাতে মুহাম্মাদী তাঁর উপর এবং তাদের উপর সালাম পেশ করছে, তারা কাফের ও বাতিলপন্থী এবং আল্লাহর প্রতি খুবই খারাপ ধারণা পোষণকারী। কারণ আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা কুফরীরই নামান্তর।
সুতরাং অধিকাংশ লোকই আল্লাহর প্রতি অন্যায় ও খারাপ ধারণা পোষণ করে থাকে। যাদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলা তা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন সেই কেবল বাঁচতে পেরেছে। মানুষ মনে করে তাকে স্বীয় হক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, অথবা কমিয়ে দেয়া হয়েছে, সে মনে করে, আল্লাহ্ তাকে যা দিয়েছেন, সে তার চেয়ে আরও বেশী পাওয়ার হকদার ছিল, মুখে উচ্চারণ না করলেও তার অবস্থার ভাষা বলছে, আমার রব আমার উপর জুলুম করেছেন, আমার অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত রেখেছেন। তার নফস্ এই কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে। যদিও তার জবান তা অস্বীকার করছে। কেননা সে তা খোলাখুলি উচ্চারণ করতে সাহস পাচ্ছেনা। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজের নফসের মধ্যে অনুসন্ধান চালাবে, সে তাতে এই কথার সত্যতা খুঁজে পাবে। এই ধারণাটি তার মধ্যে সেভাবেই লুকিয়ে থাকে যেমন আগুন দিয়াশলাইয়ের মধ্যে লুকায়িত থাকে। সুতরাং তুমি যদি এ কথার সত্যতা যাচাই করতে চাও, তাহলে কারও দিয়াশলাইয়ে আঘাত করে দেখ (কোন মানুষকে পরীক্ষা করে দেখ)। অচিরেই সে তার ভিতরের অবস্থা কিছু হলেও প্রকাশ করে দিবে। তুমি দেখবে, সে তার তাকদীরের উপর আপত্তি উত্থাপন করছে, স্বীয় তাকদীরকে দোষারোপ করছে এবং তাকদীরে যা লিখিত হয়েছে, তার বিপরীত প্রস্তাব করছে। কেউ কম করছে আবার কেউ বেশী করছে। প্রত্যেকের উচিৎ নিজ নিজ নফ্সের খোঁজ-খবর নেওয়া এবং আত্মসমালোচনা করা। সে এই রেসূ থেকে মুক্ত কি না? কবির ভাষায় বলতে গেলেঃ
ﻓﺈﻥ ﺗﻨﺞُ ﻣﻨﻬﺎ ﺗﻨﺞُ ﻣﻦ ﺫﻱ ﻋﻈﻴﻤﺔ + ﻭﺇﻻ ﻓﺈﻧﻲ ﻻ ﺇﺧﺎﻟﻚ ﻧﺎﺟﻴﺎ
‘‘হে বন্ধু! তুমি যদি এ থেকে (তাকদীরের উপর আপত্তি করা থেকে) মুক্ত হয়ে থাক তাহলে জেনে রাখ তুমি বিরাট একটি মসীবত থেকে মুক্তি পেলে। এ থেকে মুক্তি না পেলে তুমি নাজাত পাবে বলে আমার মনে হয়না।
সুতরাং এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিরই উচিৎ নিজ নিজ আত্মার খবর নেওয়া, আত্মাকে উপদেশ দেয়া এবং প্রতিটি মুহূর্তেই আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা, দু’আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। তিনি যেন তাকে তাঁর প্রতি খারাপ ধারণা থেকে মাহফুজ রাখেন এবং সেই অনুযায়ী আমলে সালেহ করার তাওফীক দেন। আমীন।
অতঃপর আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণার বিষয়টি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। উহুদ যুদ্ধের দিন আল্লাহ্ তা‘আলা মুনাফেক ও দুর্বল ঈমানের অধিকারীদের প্রকৃত অবস্থা ফাঁস করে দিয়ে বলেন-
ﺛُﻢَّ ﺃَﻧْﺰَﻝَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِ ﺍﻟْﻐَﻢِّ ﺃَﻣَﻨَﺔً ﻧُﻌَﺎﺳًﺎ ﻳَﻐْﺸَﻰ ﻃَﺎﺋِﻔَﺔً ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﻭَﻃَﺎﺋِﻔَﺔٌ ﻗَﺪْ ﺃَﻫَﻤَّﺘْﻬُﻢْ ﺃَﻧْﻔُﺴُﻬُﻢْ ﻳَﻈُﻨُّﻮﻥَ ﺑِﺎﻟﻠﻪِ ﻏَﻴْﺮَ ﺍﻟْﺤَﻖِّ ﻇَﻦَّ ﺍﻟْﺠَﺎﻫِﻠِﻴَّﺔِ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﻥَ ﻫَﻞْ ﻟَﻨَﺎ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺄَﻣْﺮِ ﻣِﻦْ ﺷَﻲْﺀٍ ﻗُﻞْ ﺇِﻥَّ ﺍﻟْﺄَﻣْﺮَ ﻛُﻠَّﻪُ ﻟِﻠﻪِ ﻳُﺨْﻔُﻮﻥَ ﻓِﻲ ﺃَﻧْﻔُﺴِﻬِﻢْ ﻣَﺎ ﻟَﺎ ﻳُﺒْﺪُﻭﻥَ ﻟَﻚَ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﻥَ ﻟَﻮْ ﻛَﺎﻥَ ﻟَﻨَﺎ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﺄَﻣْﺮِ ﺷَﻲْﺀٌ ﻣَﺎ ﻗُﺘِﻠْﻨَﺎ ﻫَﺎﻫُﻨَﺎ ﻗُﻞْ ﻟَﻮْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﻓِﻲ ﺑُﻴُﻮﺗِﻜُﻢْ ﻟَﺒَﺮَﺯَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻛُﺘِﺐَ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢُ ﺍﻟْﻘَﺘْﻞُ ﺇِﻟَﻰ ﻣَﻀَﺎﺟِﻌِﻬِﻢْ ﻭَﻟِﻴَﺒْﺘَﻠِﻲَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻣَﺎ ﻓِﻲ ﺻُﺪُﻭﺭِﻛُﻢْ ﻭَﻟِﻴُﻤَﺤِّﺺَ ﻣَﺎ ﻓِﻲ ﻗُﻠُﻮﺑِﻜُﻢْ ﻭَﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠِﻴﻢٌ ﺑِﺬَﺍﺕِ ﺍﻟﺼُّﺪُﻭﺭِ
‘‘অতঃপর তোমাদের উপর শোকের পর শান্তি অবতীর্ণ করলেন, যা ছিল তন্দ্রার মত। সে তন্দ্রায় তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ ঝিমোচ্ছিল আর কেউ কেউ প্রাণের ভয়ে (নিজের জীবনকে নিয়ে) ব্যস্ত ছিল। আল্লাহ্ সম্পর্কে তাদের মিথ্যা ধারণা হচ্ছিল মূর্খদের মত। তারা বলছিল আমাদের হাতে কি কিছুই করার নেই? তুমি বল, সবকিছুই আল্লাহর হাতে। তারা যা কিছু মনে লুকিয়ে রাখে-তোমার নিকট প্রকাশ করে না সে সবও। তারা বলে আমাদের হাতে যদি কিছু করার থাকতো, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতামনা। তুমি বল, তোমরা যদি নিজেদের ঘরেও থাকতে তথাপি যাদের ভাগ্যে মৃত্যু লিখা ছিল, তারা তাদের মৃত্যুশয্যা পানে বের হয়ে পড়ত। তোমাদের অন্তরে যা রয়েছে, তার পরীক্ষা করা ছিল আল্লাহর ইচ্ছা, আর তোমাদের অন্তরে যা কিছু রয়েছে তা পরিষ্কার করা ছিল তার কাম্য। আল্লাহ্ মনের গোপন বিষয় জানেন’’।[1] আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণার কারণেই তারা বলেছিল- এ ব্যাপারে অর্থাৎ পরামর্শ দেয়া ও সিদ্বান্ত গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের হাতে কি কিছু করার ছিল? তারা আরও বলেছিল, উহুদ যুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্বান্ত গ্রহণে আমাদের হাতে যদি কিছু থাকত, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতামনা। এই কথার মাধ্যমে তারা তাকদীরকে অস্বীকার করছে। তারা যদি তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস করত, তাহলে তাদেরকে দোষারোপ করা হতনা এবং এই ভাবে জবাব দেয়া হতনাঃ আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- ﻗُﻞْ ﺇِﻥَّ ﺍﻟْﺄَﻣْﺮَ ﻛُﻠَّﻪُ ﻟِﻠﻪِ তুমি বল, সবকিছুই আল্লাহর হাতে। এ জন্যই অনেকেই বলেছেন- তারা যেহেতু বলেছিল, এ ব্যাপারে তাদের হাতে যদি কিছু করার থাকত, তাহলে তারা নিহত হতনা, তাই তাদের এ কথা তাকদীরকে মিথ্যা বলারই শামিল। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- সব কিছুই আল্লাহর হাতে। সুতরাং যা কিছু পূর্ব থেকেই তাকদীরে লিখিত আছে তাই হবে। যার ভাগ্যে নিহত হওয়া লিখিত আছে, সে ঘরে বসে থাকার ইচ্ছা করলেও যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে অবশ্যই নিহত হবে। এতে কাদরীয়া সম্প্রদায় তথা তাকদীরকে অস্বীকারকারীদের কড়া প্রতিবাদ করা হয়েছে।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের আরেকটি হিকমত হচ্ছে, তাদের অন্তরে যে ঈমান বা নিফাক লুকায়িত আছে, তা যাচাই ও পরীক্ষা করা। এতে মুমিনদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পাবে। আর মুনাফেক এবং যাদের অন্তর রেসূাক্রান্ত তাদের নিফাকী প্রকাশিত হয়ে যাবে। মুমিনদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন করাও উদ্দেশ্য ছিল। কেননা মানুষের অন্তরে কখনও কখনও নাফসানী খাহেশাত, কুস্বভাব ও প্রবৃত্তির চাহিদা, সামাজিক রসম-রেওয়াজ প্রীতি, শয়তানের প্ররোচনা এবং গাফেলতি প্রবেশ করে থাকে। এতে অন্তরসমূহ প্রভাবিত হয় এবং এগুলো পরিপূর্ণ ঈমানের পরিপন্থীও বটে। মুমিনগণ যদি সবসময় বিপদমুক্ত থাকে এবং সুখ-সাচ্ছন্দে জীবন-যাপন করে তাহলে, তাদের অন্তর নিফাকী ও গাফেলতী থেকে পবিত্র হবেনা। সুতরাং এই পরাজয়ের মাধ্যমে তাদের উপর রহম করা হয়েছে। এটি বিজয়ের নিয়ামাত দান করার সমতুল্য।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- যে সমস্ত খাঁটি মুমিন উহুদ যুদ্ধের দিন পলায়ন করেছিল, তারা তাদের পাপের কারণেই এমনটি করেছিল। শয়তান তাদেরকে এমন কাজের প্রতি উৎসাহিত করেছিল, যার মাধ্যমে শত্রুদের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল। কেননা বান্দার আমলসমূহ কখনও তার পক্ষের সৈনিক হয় আবার কখনও তার বিপক্ষের সৈনিকে পরিণত হয়। সুতরাং যে মুহূর্তে মুমিন বান্দা শত্রুর মুকাবেলা করতে সক্ষম, তখন যদি সে ময়দান ছেড়ে পলায়ন করে তখন সেই পলায়ন তার এমন আমলের কারণেই, যার প্রতি শয়তান প্ররোচিত করেছিল।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি মুসলমানদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কেননা তাদের এই পলায়ন নিফাকী বা রসূল (সাঃ) সত্য নাবী হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের কারণে ছিলনা। এটি হয়েছিল আকস্মিকভাবে। এটি হয়েছিল তাদের কৃত কর্মের কারণে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﺃَﻭَﻟَﻤَّﺎ ﺃَﺻَﺎﺑَﺘْﻜُﻢْ ﻣُﺼِﻴﺒَﺔٌ ﻗَﺪْ ﺃَﺻَﺒْﺘُﻢْ ﻣِﺜْﻠَﻴْﻬَﺎ ﻗُﻠْﺘُﻢْ ﺃَﻧَّﻰ ﻫَﺬَﺍ ﻗُﻞْ ﻫُﻮَ ﻣِﻦْ ﻋِﻨْﺪِ ﺃَﻧْﻔُﺴِﻜُﻢْ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻋَﻠَﻰ ﻛُﻞِّ ﺷَﻲْﺀٍ ﻗَﺪِﻳﺮٌ
‘‘যখন তোমাদের উপর একটি মসীবত এসে পৌঁছাল, অথচ তোমরা তার পুর্বেই দ্বিগুণ কষ্টে পৌঁছে গিয়েছ, তখন কি তোমরা বলবে, এটা কোথা থেকে এল? তাহলে বলে দাও, এ কষ্ট তোমাদের উপর পৌঁছেছে তোমাদেরই পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ প্রত্যেক বিষয়ের উপর ক্ষমতাশীল’’। (সূরা আল-ইমরান-৩: ১৬৫)
মুসলমানদের বিপদাপদ ও কষ্টে নিপতিত হওয়ার বিষয়টি মক্কী সূরসূমূহে আরও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻣَﺎ ﺃَﺻَﺎﺑَﻜُﻢْ ﻣِﻦْ ﻣُﺼِﻴﺒَﺔٍ ﻓَﺒِﻤَﺎ ﻛَﺴَﺒَﺖْ ﺃَﻳْﺪِﻳﻜُﻢْ ﻭَﻳَﻌْﻔُﻮ ﻋَﻦْ ﻛَﺜِﻴﺮٍ
‘‘তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ্ ক্ষমা করে দেন’’। (সূরা শুরা-৪২:৩০) আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-
ﺃَﻳْﻨَﻤَﺎ ﺗَﻜُﻮﻧُﻮﺍ ﻳُﺪْﺭِﻛُﻜُﻢُ ﺍﻟْﻤَﻮْﺕُ ﻭَﻟَﻮْ ﻛُﻨْﺘُﻢْ ﻓِﻲ ﺑُﺮُﻭﺝٍ ﻣُﺸَﻴَّﺪَﺓٍ ﻭَﺇِﻥْ ﺗُﺼِﺒْﻬُﻢْ ﺣَﺴَﻨَﺔٌ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﺍ ﻫَﺬِﻩِ ﻣِﻦْ ﻋِﻨْﺪِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﺇِﻥْ ﺗُﺼِﺒْﻬُﻢْ ﺳَﻴِّﺌَﺔٌ ﻳَﻘُﻮﻟُﻮﺍ ﻫَﺬِﻩِ ﻣِﻦْ ﻋِﻨْﺪِﻙَ ﻗُﻞْ ﻛُﻞٌّ ﻣِﻦْ ﻋِﻨْﺪِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻓَﻤَﺎﻝِ ﻫَﺆُﻟَﺎﺀِ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡِ ﻟَﺎ ﻳَﻜَﺎﺩُﻭﻥَ ﻳَﻔْﻘَﻬُﻮﻥَ ﺣَﺪِﻳﺜًﺎ
‘‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন; মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই- যদি তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের ভিতরেও অবস্থান কর, তবুও। বস্ত্তত তাদের কোন কল্যাণ সাধিত হলে তারা বলে যে, এটা সাধিত হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর যদি তাদের কোন অকল্যাণ হয়, তবে বলে, এটা হয়েছে তোমার পক্ষ থেকে, বলে দাও, এ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। তবে তাদের কী হল যে, তারা কখনও কোন কথা বুঝতে চেষ্টা করেনা’’। (সূরা নিসা-৪:৭৮) সুতরাং নিয়ামত অর্জিত হলে তা আল্লাহর ফজল ও করমের ফলেই হয়ে থাকে।
আর মসীবত নাজিল হলে তাঁর পক্ষ হতে ন্যায় বিচার ও ইনসাফের কারণেই হয়ে থাকে। পরিশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻋَﻠَﻰ ﻛُﻞِّ ﺷَﻲْﺀٍ ﻗَﺪِﻳﺮٌ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ প্রত্যেক বিষয়ের উপর ক্ষমতাশীল’’। (সূরা আল-ইমরান-৩:১৬৫) তার আগে তিনি বলেন- যে মসীবতে তোমরা পড়েছ, তা তোমাদের হাতের কামাই। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইনসাফের সাথে আল্লাহ্ তা‘আলার ক্ষমতা অত্যন্ত ব্যাপক। এখানে তাকদীর তথা ভাগ্যের লিখন এবং বান্দার প্রচেষ্টা- উভয়টি সাব্যস্ত করা হয়েছে। আমল ও চেষ্টার নিসবত (সম্বন্ধ) করা হয়েছে বান্দাদের দিকে এবং কুদরত তথা ক্ষমতার নিসবত (সম্বন্ধ) করা হয়েছে আল্লাহর দিকে। এখানে জাবরীয়া সম্প্রদায় অর্থাৎ যারা বলে, বান্দা যা কিছু করে তার সবই আল্লাহর পক্ষ হতেই হয়ে থাকে। তাতে বান্দার কোন হাত নেই। বান্দা কাঠের পুতুলের ন্যায় এবং শিশুর হাতে লাটিমের ন্যায়। শিশু লাটিম যেভাবে ঘুরায়, লাটিম সেভাবেই ঘুরে। বান্দার বিষয়টিও একই রকম। আল্লাহ্ তাকে যেভাবে চালান, সেভাবেই চলে। বান্দার কোন স্বাধীনতা নেই। সুতরাং ভাল-মন্দ সবই আল্লাহর পক্ষ হতে।
সেই সাথে এখানে কাদরীয়া সম্প্রদায় অর্থাৎ যারা তাকদীরকে অস্বীকার করে তাদেরও প্রতিবাদ করা হয়েছে। কাদরীয়াদের পরিচয় হল, তারা বলে বান্দার ভাল-মন্দ সকল কাজে বান্দা স্বাধীন। তাতে আল্লাহর কোন হাত নেই। এমন কি বান্দা কাজটি করার আগে আল্লাহ্ তা‘আলা জানতেও পারেন না।
কুরআন ও হাদীছের দলীল উপরোক্ত দলটির কঠোর প্রতিবাদ করেছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻟِﻤَﻦْ ﺷَﺎﺀَ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﺃَﻥْ ﻳَﺴْﺘَﻘِﻴﻢَ ﻭَﻣَﺎ ﺗَﺸَﺎﺀُﻭﻥَ ﺇِﻟَّﺎ ﺃَﻥْ ﻳَﺸَﺎﺀَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺭَﺏُّ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴﻦَ
‘‘ তার জন্যে, যে তোমাদের মধ্যে সোজা পথে চলতে চায়। তোমরা আল্লাহ্ রাববুল আলামীনের অভিপ্রায়ের বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পারনা’’। (সূরা তাকভীর-৮১:২৮-২৯) উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের যেই কষ্ট হয়েছিল তার দিকে ইঙ্গিত প্রদান করে নাযিলকৃত আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলার কুদরত (ক্ষমতার) উল্লেখ করার মধ্যে একটি সুক্ষ্ম বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে উহুদ যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের বিষয়টি সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। সুতরাং এ বিষয়ে আল্লাহ্ যা বলেছেন, তা ব্যতীত অন্য কারও কাছে ব্যাখ্যা তলব করা ঠিক নয়। অন্য আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻣَﺎ ﺃَﺻَﺎﺑَﻜُﻢْ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﺘَﻘَﻰ ﺍﻟْﺠَﻤْﻌَﺎﻥِ ﻓَﺒِﺈِﺫْﻥِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﻟِﻴَﻌْﻠَﻢَ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﻭَﻟِﻴَﻌْﻠَﻢَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻧَﺎﻓَﻘُﻮﺍ
‘‘আর যেদিন দু’দল সৈন্যের মোকাবিলা হয়েছে; সেদিন তোমাদের উপর যা আপতিত হয়েছে তা আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে এবং তা এজন্য যে, যাতে ঈমানদারদেরকে জানা যায়’’। (সূরা আল-ইমরান-৩:১৬৬-১৬৭) এখানে আল্লাহুর হুকুমেই উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয় হয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর হুক্মে তাকভীনি বা তাকদীরী। অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টিগত হুকুম উদ্দেশ্য। যেই হুকুমের মাধ্যমে তিনি সকল বস্ত্ত সৃষ্টি করেছেন। শরীয়তের হুকুম উদ্দেশ্য নয়।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদেরকে পরাজিত করার মাধ্যমে খাঁটি মুমিনদেরকে জানতে চেয়েছেন এবং মুনাফেকদেরকে মুসলমানদের থেকে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য করতে চেয়েছেন। এর মাধ্যমে মুনাফেকরা তাদের অন্তরের গোপন বিষয় বের করে দিয়েছিল। মুমিনগণ তা শুনেও ফেলল এবং তারা আল্লাহ্ তা‘আলা কিভাবে তাদের জবাব দিয়েছেন তাও শুনতে পেল। সেই সাথে মুনাফেকদের ষড়যন্ত্র ও তার পরিণাম সম্পর্কেও জানা হয়ে গেল।
সুতরাং উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের ঘটনার মধ্যে যে কত হিকমত, নিয়ামাত ও উপদেশ নিহিত আছে, তার প্রকৃত হিসাব আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানে না।
পরিশেষে উহুদ যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবী শাহাদাত বরণ করার কারণে মুসলমানদের অন্তরে যেই আঘাত লেগেছিল তা দূর করার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে অত্যন্ত উত্তম ভাষায় শান্তনা দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
ﻭَﻟَﺎ ﺗَﺤْﺴَﺒَﻦَّ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻗُﺘِﻠُﻮﺍ ﻓِﻲ ﺳَﺒِﻴﻞِ ﺍﻟﻠﻪِ ﺃَﻣْﻮَﺍﺗًﺎ ﺑَﻞْ ﺃَﺣْﻴَﺎﺀٌ ﻋِﻨْﺪَ ﺭَﺑِّﻬِﻢْ ﻳُﺮْﺯَﻗُﻮﻥَ ﻓَﺮِﺣِﻴﻦَ ﺑِﻤَﺎ ﺁَﺗَﺎﻫُﻢُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻣِﻦْ ﻓَﻀْﻠِﻪِ ﻭَﻳَﺴْﺘَﺒْﺸِﺮُﻭﻥَ ﺑِﺎﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻟَﻢْ ﻳَﻠْﺤَﻘُﻮﺍ ﺑِﻬِﻢْ ﻣِﻦْ ﺧَﻠْﻔِﻬِﻢْ ﺃَﻟَّﺎ ﺧَﻮْﻑٌ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﻭَﻟَﺎ ﻫُﻢْ ﻳَﺤْﺰَﻧُﻮﻥَ ﻳَﺴْﺘَﺒْﺸِﺮُﻭﻥَ ﺑِﻨِﻌْﻤَﺔٍ ﻣِﻦَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﻓَﻀْﻞٍ ﻭَﺃَﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻟَﺎ ﻳُﻀِﻴﻊُ ﺃَﺟْﺮَ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺍﺳْﺘَﺠَﺎﺑُﻮﺍ ﻟِﻠﻪِ ﻭَﺍﻟﺮَّﺳُﻮﻝِ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِ ﻣَﺎ ﺃَﺻَﺎﺑَﻬُﻢُ ﺍﻟْﻘَﺮْﺡُ ﻟِﻠَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﺣْﺴَﻨُﻮﺍ ﻣِﻨْﻬُﻢْ ﻭَﺍﺗَّﻘَﻮْﺍ ﺃَﺟْﺮٌ ﻋَﻈِﻴﻢٌ
‘‘আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করোনা। বরং তাঁরা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত। আল্লাহ্ নিজের অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তার প্রেক্ষিতে তারা আনন্দ উদ্যাপন করছে। আর যারা এখনও তাদের কাছে এসে পৌঁছেনি তাদের পেছনে তাদের জন্য আনন্দ প্রকাশ করে। কারণ, তাদের কোন ভয়-ভীতিও নেই এবং কোন চিন্তা-ভাবনা নেই। আল্লাহর নিয়ামাত ও অনুগ্রহের জন্য তাঁরা আনন্দ প্রকাশ করে এবং তা এভাবে যে, আল্লাহ্ ঈমানদারদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না। যারা আহত হওয়ার পরেও আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের নির্দেশ মান্য করেছে, তাদের মধ্যে যারা সৎ ও মুত্তাকী, তাদের জন্য রয়েছে মহান ছাওয়াব।[2] আল্লাহ্ তা‘আলা এই আয়াত সমূহে শহীদদের জন্য চিরস্থায়ী জিন্দিগী, আল্লাহর নৈকট্য প্রদান, অবিরাম রিযিক চালু রাখার ঘোষণা করেছেন। তাই শহীদগণ আল্লাহর অনুগ্রহ পেয়ে অত্যন্ত খুশী ও সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাদের যে সমস্ত মুসলমান ভাই শহীদ হয়ে এখনও তাদের সাথে মিলিত হয় নি, পরবর্তীতে তারা শহীদ হয়ে এসে তাদের সাথে মিলিত হওয়ার সুসংবাদ শুনেও তারা আনন্দিত হয়। তাদের আনন্দ, নিয়ামাত, এবং সুসংবাদ প্রতি মুহূর্তে তাদের জন্য বর্ধিত সম্মান প্রাপ্তির মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করবে।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয়ের বিনিময়ে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা অফুরন্ত নিয়ামাত প্রদানের কথা উল্লেখ করেছেন। যেই নিয়ামাতগুলোর তুলনায় উহুদ যুদ্ধের মসীবত খুবই সামান্য। নিয়ামাতগুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করলে উহুদ যুদ্ধে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে মুসলমানদের কষ্টের অসিত্মত্বই খুঁজে পাওয়া যাবেনা। সেই নেয়ামতগুলোর অন্যতম হচ্ছে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের মধ্য হতেই একজন রসূল পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের নিকট আল্লাহর আয়াত পাঠ করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন, আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাত শিক্ষা দেন এবং গোমরাহীর অন্ধকার থেকে হিদায়াতের (আলোর) দিকে বের করেন। এই বিরাট কল্যাণের পর সকল বালা-মসীবত খুবই নগণ্য। আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেছেন যে, এই মসীবতের কারণ স্বয়ং মুসলিমরাই। যাতে তারা আগামীতে সংশোধন হয়ে যায় এবং সাবধানতা অবলম্বন করে। আর তাদের এই পরাজয় পূর্ব নির্ধারিত তাকদীর অনুযায়ীই হয়েছিল। সুতরাং তাদের উচিৎ সবসময় এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না করা। আল্লাহ্ তা‘আলা উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের হিকমতগুলো এই জন্যই বলে দিয়েছেন, যাতে তারা আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করে এবং সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর হিকমতের উপর ইয়াকীন রাখে এবং আল্লাহর উপর কোন প্রকার খারাপ ধারণা পোষণ থেকে বিরত থাকে। সেই সাথে যাতে করে তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার আসমায়ে হুসনা ও সিফাতে কামালিয়াতের মারেফতও হাসিল হয়ে যায়।
পরিশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে শান্তনা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, তিনি তাদেরকে এমন জিনিষ দিয়ে সম্মানিত করেছেন, যা বিজয় ও গণীমতের চেয়ে অনেক বড়। আর তা হচ্ছে শাহাদাতের মর্যাদা। এভাবে শান্তনা দেয়ার কারণ হচ্ছে, যাতে তারা তা পাওয়ার জন্য প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয় এবং যারা নিহত হয়েছে তাদের জন্য চিন্তিত না হয়। সুতরাং এর জন্য আমরা আল্লাহর সেরকমই প্রশংসা করছি, যেমন প্রশংসা তিনি পাওয়ার হকদার।
[1]. সূরা আল-ইমরান-৩:১৫৪ [2].সূরা আল-ইমরান-৩:১৬৯-১৭২
0 Comments