মুহাররম ও আশুরা সম্পর্কে।

মুহাররম ও আশুরা: -------------------------------- আজ মুহাররম মাসের ৪ তারিখ। আগামী শুক্রবার হবে ১০ তারিখ। মুহররমের দশ তারিখকে বলা হয় আশুরা। আশুরা বিষয়ে আমাদের মধ্যে নানারকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে। তাই এই ছোট্ট লেখা। হিজরি সনের প্রথম মাস হচ্ছে মুহররাম। এর অর্থ নিষিদ্ধ অথবা সম্মানিত। ইসলামের পূর্ব থেকেই এ মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিলো। আরবি বারো মাসের মধ্যে এ ধরনের মাস হলো চারটি। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, ﺇِﻥَّ ﻋِﺪَّﺓَ ﺍﻟﺸُّﻬُﻮﺭِ ﻋِﻨْﺪَ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺍﺛْﻨَﺎ ﻋَﺸَﺮَ ﺷَﻬْﺮًﺍ ﻓِﻲ ﻛِﺘَﺎﺏِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻳَﻮْﻡَ ﺧَﻠَﻖَ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﻭَﺍﺕِ ﻭَﺍﻟْﺄَﺭْﺽَ ﻣِﻨْﻬَﺎ ﺃَﺭْﺑَﻌَﺔٌ ﺣُﺮُﻡٌ ﺫَﻟِﻚَ ﺍﻟﺪِّﻳﻦُ ﺍﻟْﻘَﻴِّﻢُ ﻓَﻠَﺎ ﺗَﻈْﻠِﻤُﻮﺍ ﻓِﻴﻬِﻦَّ ﺃَﻧْﻔُﺴَﻜُﻢْ . অর্থ- আল্লাহ তা‘আলার বিধান মতে মাসের সংখ্যা মোট বারোটি, আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির দিন হতেই। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এ মাসসমূহে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না। (সূরা তওবা, আয়াত ৩৬) মুহাররম মাসের রোযা: এ মাসে রোযা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ।’ ﺃﻓﻀﻞ ﺍﻟﺼﻴﺎﻡ ﺑﻌﺪ ﺭﻣﻀﺎﻥ ﺷﻬﺮ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﻤﺤﺮﻡ -সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিযী ১/১৫৭ এর মধ্যে আশুরার রোযার ফযীলত আরও বেশি: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ ﻣﺎ ﺭﺃﻳﺖ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻳﺘﺤﺮﻯ ﺻﻴﺎﻡ ﻳﻮﻡ ﻓﻀﻠﻪ ﻋﻠﻰ ﻏﻴﺮﻩ ﺇﻻ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﻴﻮﻡ ﻳﻮﻡ ﻋﺎﺷﻮﺭﺍﺀ ﻭﻫﺬﺍ ﺍﻟﺸﻬﺮ ﻳﻌﻨﻲ ﺭﻣﻀﺎﻥ -সহীহ বুখারী ১/২১৮ হযরত আলী রা.কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপসি'ত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’-জামে তিরমিযী ১/১৫৭ অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ ﺻﻴﺎﻡ ﻳﻮﻡ ﻋﺎﺷﻮﺭﺍﺀ ﺃﺣﺘﺴﺐ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﺃﻥ ﻳﻜﻔﺮ ﺍﻟﺴﻨﺔ ﺍﻟﺘﻲ ﻗﺒﻠﻪ -সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিযী ১/১৫৮ আশুরার রোযা সম্পর্কে এক হাদীসে আছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ।’ ﺻﻮﻣﻮﺍ ﻋﺎﺷﻮﺭﺍﺀ ﻭﺧﺎﻟﻔﻮﺍ ﻓﻴﻪ ﺍﻟﻴﻬﻮﺩ، ﺻﻮﻣﻮﺍ ﻗﺒﻠﻪ ﻳﻮﻣﺎ ﺃﻭ ﺑﻌﺪﻩ ﻳﻮﻣﺎ মুসনাদে আহমদ ১/২৪১ হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোযা রাখব।’-সহীহ মুসলিম ১/৩৫৯ মুহাররম ও আশুরাকেন্দ্রিক নানা কুসংস্কার: এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।-সহীহ বুখারী ১/৪৮১ তবে এ দিনের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকেন। যেমন, এদিন হযরত ইউসুফ আ. জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইয়াকুব আ. চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। হযরত ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইদরীস আ.কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। অনেকে বলে, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই।-আল আসারুল মারফূআ, আবদুল হাই লাখনেবী ৬৪-১০০; মা ছাবাহা বিসসুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ ২৫৩-২৫৭ কারবালা প্রসঙ্গে: সবকিছুর মূল্যায়ন ঠিক ওভাবেই করতে হবে, সেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম করে গেছেন। আমরা অনেকেই মনে করি, আশুরা মানে কারবালা। আশুরাকে আমরা কারবালা বানিয়ে ফেলেছি। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশুরার রোযা রাখেন এবং উম্মাহকে রোযা রাখার জন্য নির্দেশ দেন ওই সময় কারবালার ঘটনা ঘটেই নি। অবশ্য কারবালার ঘটনা ও আশুরার তারিখে সংঘটিত হয়েছে যা নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক। তবে সেই বেদনার স্মৃতি চারণ উপলক্ষ্যে আশুরা পালনের কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম বলেন নি। অন্যান্য বেদনাদায়ক ঘটনার স্মৃতি স্মরণ হলে যেমন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়তে হয়, আশূরার দিনেও আমরা তা পাঠ করতে পারি। কিছু সূরা কালাম ও দুআ দরুদ পড়ে শুহাদা গণের জন্য দুআ করা যেতে পারে। এদিন আমরা রোযাও রাখবো, তবে তা পূর্ববর্তী নবীগণের ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত হিসেবে; কারবালা উপলক্ষ্যে নয়। কারবালার ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে এটি একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা-‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়।’ অন্য হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।’ অতএব শাহাদাতে হুসাইন রা.কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। এ মাসে যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় তার মধ্যে তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ করা যায়। এজন্য অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকে। এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার। এসমস্ত কুসংস্কারের অধিকাংশই এসেছে শিয়াদের থেকে। ভ্রান্ত শিয়া ফেরকা সম্পর্কে আগামী প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহু তা'আলা। সারকথা, এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো হলো: তওবা- ইস্তেগফার, নফল রোযা এবং অন্যান্য নেক আমল। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়া আর সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

Post a Comment

0 Comments